ভৌগলিক জ্ঞানের বিকাশে টলেমীর অবদান মূল্যায়ন

ভৌগোলিক জ্ঞান বিজ্ঞানে যে কয়জন রোমান ভূগোলবিদ অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ক্লাউডিয়াস টলেমী- (claudius Tolemy) অন্যতম। রোমান ভূগোলবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি ছিল সুদূর প্রসারিত। রোমান যুগে বিভিন্ন কারনে যখন জ্ঞান-চর্চা স্তিমিত হয়ে যাচ্ছিল তখন টলেল্পী সাহসিকতার সাথে তার জ্ঞান চর্চা অব্যাহত রাখেন। ভৌগোলিক জ্ঞান বিকাশে তাই তার অবদান অসামান্য।

টলেমীর পৃথিবীর মানচিত্র
টলেমীর পৃথিবীর মানচিত্র

জন্ম-পরিচয়ঃ ক্লাউডিয়াস টলেমী গ্রিসীয় রোমান যুগের সর্বশ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ, জ্যোতির্বিদ, গাণিতিক, দার্শনিক ও মানচিত্র বিদ ছিলেন। তার জন্মস্থান ও জন্ম তারিখ সম্বন্ধে  সঠিক তথ্য পাওয়া না গেলেও কিছু সংখ্যক প্রাচীন পাণ্ডুলিপি থেকে জান যায় যে, তিনি পেলুশিয়ানে জন্মগ্রহণ করেন। তবে কোন কোন পন্ডিতের মতে  তিনি ৯০ থকে  ১৬৮ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে  আনেক্যান্দ্রিয়ায় জীবনের বেশিরভাগ সময় অতিবাহিত করেন। 


টলে মির ভৌগোলিক অবদানঃ- ভৌগোলিক জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্রে টলেমীর অবদান সমধিক প্রসিদ্ধ। তিনি ভুগোলের যে সকল আথায় অবদান রাখেন তা নিম্নে আলোচিত হলঃ-


১. টলেমীর রচনাবলীঃ- তিনি আলমাজেষ্ট (Almagest) জিওগ্রাফিকা  (Geographica) ভুগোলের পথ প্রদর্শন (Guide to geography) নামক গ্রন্থে ভূগোল সম্পর্কিত  নানাবিধ বিষয় ব্যাখ্যা করেন। আলমাজেষ্ট গ্রন্থটি ১৩ টি খন্ডে লিখিত একটি সমষ্টিগত পুস্তক যাতে তিনি তাঁর বৈজ্ঞানিক মতবাদ গুলো অন্তর্ভুক্ত করেন।  জিওগ্রাফিকা গ্রন্থটি ৮টি খন্ডে বিভক্ত , যাতে তিনি অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমারেখার হিসাব সম্বলিত গাণিতিক বিষয় এবং হাজার অঞ্চলের নাম বর্ণনা করেন  ও অংকন বিদ্যার অংশ হিসেবে গণিতের গুরুত্ব তুলে ধরেন।


২. পৃথিবী সম্পর্কে ধারণাঃ টলেমী প্রাচীন ধারণা পৃথিবী স্থির সম্পর্কে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলেছেন, পৃথিবীর আকার সম্পূর্ণ গোল এবং ইহা স্থলও সমদ্রের সমন্বয়ে গঠিত; এর চারদিকে সমুদ্রে আছে বলে তাঁর বিশ্বাস। তিনি পৃথিবীদে অত্যন্ত ক্ষুদ্র বলে মনে করতেন। পৃথিবীর আবর্তন সম্বন্ধে তার ধারণা স্পষ্ট নয়। তার মতে আকাশ বৃহৎ গর্ত যুক্ত  গোলাকার এবং পৃথিবী আকাশের মধ্যস্থলে রয়েছে। তিনি পৃথিবীর উত্তর অক্ষাংশ গুলোর দীর্ঘতম দিনের বিস্তৃতি দেখান এবং চার ডিগ্রি থেকে ৬৩ ডিগ্রি উত্তর অক্ষরেখা পর্যন্ত অংশকে দিবালোক ঘন্টায় (Daylight hour) ২১ টি জলবায়ু অঞ্চলে বিভক্ত করেন।


৩. বাসযোগ্য পৃথিবী সম্পর্কে ধারণাঃ টলেমী বাসযোগ্য পৃথিবীর বিস্তৃতি খুবই কম বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন বাসযোগ্য পৃথিবীর দক্ষিণ অংশে অন্তর্গত টেরা অস্টালিজ ইনকগনিটা নামক এটি ভূ-ভাগ  রয়েছে এবং ভূভাগ ভারত মহাসাগর বেষ্টন করে আছে। টলেমীর এই ধারণা পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া আবিষ্কারে সহায়তা করে ছিল। এছাড়া পশ্চিম দিকের অজ্ঞাত ভূমি ইথিও পীয় ও নিবীয় উপসাগর বেষ্টন করেছে বলে উল্লেখ করেন। তিনি নিরক্ষরেখায় পৃথিবীর বাসোপযোগী অংশকে ৯০০ মাইল বলে অনুমান করেন এবং পোসিডোনিয়াস ও ট্র্যাঁবোর অনুসরণ করে পৃথিবীর পরিধি ১৮০০০ মাইল বলে হিসাব করেন এবং ঐ পরিধিকে ৩৬০ ভোগে বিভক্ত করেন। কিন্তু পরে হিপার ডানের অনুসরণে উহা ৩৬০ ডিগ্রীতে বিভক্ত করেন। টলেমী বিভিন্ন সাগর, উপসাগর ও দ্বীপের মোটামুটি সঠিক অবস্থান সম্পর্কে ধারনা দেন।


তিনি স্কটল্যান্ডকে দীর্ঘতম এবং পরিচিত আফ্রিকার উত্তর দক্ষিণে অধিক বিস্তৃত আকারে দেখিয়েছেন এবং নীলনদের প্রকৃত উৎস নির্দেশ করতে সমর্থ হয়ে ছিলেন। এশিয়া মাইনর থেকে চীন পর্যন্ত বিস্তৃত ব্যাপক অঞ্চল সম্বন্ধে টলেমীর জান পূর্ববর্তী মানচিত্র প্রস্তুত কারকদের চেয়ে উন্নত ছিল। চীন দেশের বাণিজ্য পথ সম্পর্কে তিনি অনেক নতুন তথ্য দিতে সমর্থ হয়ে ছিলেন। বৃটেন ও বাল্টিক সাগরের দক্ষিণের দেশগুলো সম্বন্ধে পূর্ববর্তীদের চেয়ে তিনি অধিকতর মনোরম বিবরণ দিয়েছেন। গঙ্গা থেকে দূরে মালয় দ্বীপ ও চীনসহ পূর্বে স্থলভাগ আছে বলে কল্পনা টলেমীর ভূগোলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।


মানচিত্র বিদ্যায় অবদানঃ ভূগোল শাস্ত্রে টলেমীর প্রধান অবদান হচ্ছে মানচিত্র তৈরি করা এবং আর ইহা মানচিত্র অংকন বিদ্যার একটি অংশ। তিনি পৃথিবীর প্রতিকৃতি অংকন করবার যে সব পদ্ধতি উদ্ভাবন পদ্ধতি উদ্ভাবন করেন সে গুলো আধুনিক মতবাদের উপর প্রতিষ্ঠিত। টলেমি পরিচিত পৃথিবীর জন্য একটি এবং বিভিন্ন অঞ্চলের জন্য ২০টি স্বতন্ত্র মানচিত্র অংকন  ছিলেন। টলেমীর মানচিত্রাংকন  পদ্ধতিতে নিম্নের বৈশিষ্ট্যগুলো উল্লেখযোগ্য 

১. তিনি সর্ব প্রথম স্কেলের ধারণা দেন।

২. তিনি মানচিত্রে উত্তর দিক উপরে, দক্ষিণ দিক নিচে পূর্ব দিকে ডানে এবং পশ্চিম 'দিক বাম পার্শ্বে ধরে আকতেন।

৩. মানচিত্রে পূর্ব-পশ্চিম দিক ঠিক করেন

৪. যে কোন পরিমাণের জন্য তিনি জ্যাতির্বিদ্যা ব্যবহার করতেন

৫.  টলেমি আধুনিক মানচিত্রবিদদের মতে মানচিত্রে ভ্রুনেখ ব্যবহার করতেন।


৬. তাঁর পৃথিবীর মানচিত্রটি অক্ষাংশ ও দেশান্তরের উপর ভিত্তি করে আঁকা হয়েছিল। 

 ৭. ৩° অক্ষাংশ ছিল তাঁর নিরক্ষরেখা, উহা আসোয়ানের  মধ্য দিয়ে অতিক্রম করেছিল এবং ৩° কে মূল মধ্যরেখা ধরা হয়েছিল। 

৮. তাঁর উদ্ভাবিত অভিক্ষেপের অক্ষরেখা করে  ও দ্রাঘিমা রেখাগুলো চাপ কালকের আকৃতি বিশিষ্ট রেখা ছিল। 

৯. ৩৬০ ডিগ্রী কে বিভক্ত  করে প্রত্যেক ডিগ্রি কি আবার ৬০ ভাগে ভাগ করতেন, এই প্রত্যেক ক্ষুদ্র ভাগকে মিনিট বলা হয়।

১০. টলেমী বক্র রেখা দ্বারা তৈরি ছকের  মধ্যে পৃথিবীর মানচিত্র এঁকে ছিলেন।

পৃথিবীর মানচিত্র ছাড়াও টলেমী আরও ২০টি আঞ্চলিক  মানচিত্র অংকন করেছিলেন। এই সব  মানচিত্র আঁকার জন্যে অভিক্ষেপ উদ্ভাবন টলেমীর উল্লেখযোগ্য কৃতিত্ব। তাঁর উদ্ভাবিত অভিক্ষেপগুলোর মধ্যে শাভক অভিক্ষেপ, (conical projection)  অন্যতম। এ অভিক্ষেপের মধ্য দ্রাঘিমা সর্ব উত্তরে যে বিন্দুতে মিলিত হয়েছে অন্যান্য সব দ্রাঘিমা রেখা গুলো একই বিন্দুতে মিলিত হয়েছে। এছাড়া তিনি স্টেরো গ্রাফিক ও অর্থগ্রাফিক অভিক্ষেপ অঙ্কন করেন। মানচিত্রাংকন পদ্ধতির উপর রচিত টলিমির গ্রন্থের সপ্তম খন্ডে অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ অনুসারে কয়েকটি জায়গায় নির্ধারণ করা হয়েছে। এই গ্রন্থের মানচিত্রে প্রভৃতি দেশের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। 

জ্যোতিশাস্ত্রে অবদানঃ জ্যোতিশাস্ত্রে টলেমীর বিশেষ অবদান রয়েছে। তাঁর অবদান পরবর্তী জ্যোতিশাস্ত্র চর্চার ক্ষেত্রে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করে ছিল। টলেমীর Mathematical colzection' নামক প্রন্থটি পরবর্তী প্রায় ১২০০ বছর পর্যন্ত খুবই সমাদর লাভ করে ছিল। এ জন্যে তাঁকে ঐ সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতিবিদ বলা হয়। নবম শতকে আরব জ্যোতিষীরা তাঁর অবদান'কে শ্রেষ্ঠ বলে অভিহিত করে ছিলেন। তাঁর অবদানওশের মধ্যে 'Aiprefixed' নামট প্রবন্ধটি খুবই উল্লেখযোগ্য। হাইপারকামের (Hypercum) উপস্থাপিত তারকার তালি-কাকে টলেমী আরও বিস্তৃত করেন। হাইপারকাসের তালিকাতে টলেমী আরব বিস্তৃত করেন। হাইপারকামের তালিকায় ৮৫০০ তারকার বিবরণ ছিল, কিন্তু টলেমী ১০১১ টি তারকার কথা বলেন। সূর্য, চন্দ্র ও তারকা-রাজির গতি সম্বন্ধেও  তিনি হাইপার কামকে অনুসরণ করেন। তিনি পৃথিবীকে বিশ্বব্রহ্মান্ডের কেন্দ্র হিসাবে উল্লেখ করেন। অবশ্য আলমা জেষ্ট নামক গ্রন্থে তিনি পৃথিবীকে স্থির বলে প্রমাণ করতে চেয়েছেন। কেন্দ্রস্থলে পৃথিবী তারপর যথাক্রমে চন্দ্র, বুধ, শুল্ক, সূর্য, মঙ্গল, বৃহস্পতি শনি, হিসেবে তিনি গ্রহ গুলোকে সাজান। অবশ্য এই সব সূত্র উল্লেখ করে তিনি একটি ভুল তথ্য পরিবরশন করে ছিলেন। কোপারনিকাসের পূর্ব পর্যন্ত এই ধারণা অপরিবর্তিত ছিল।


টসেমী পৃথিবী থেকে চন্দ্রের বহিঃবৃত্তের দূরত্ব পরিমাপের চেষ্টা করেন এবং হাই-পারকানের 'চন্দ্র মতবাদের উন্নতি সাধন করেন। চন্দ্রের গতি ব্যতিক্রম নির্ণয়ের জন্য তিনি প্রথমে চন্দ্রের দূরত্ব নির্ণয় করেন এবৎ তা পৃথিবীর ব্যাসার্ধের ৫৯ গুণ বলে মনে করতেন। দুইটি খন্ডে বিভক্ত গ্রহতত্ত্ব' নামক গ্রন্থে তিনি আবহাওয়ার তথ্য সম্মিলিত  তারকারাজির সকালে উদয় ও সন্ধ্যায় অস্ত যাওয়ার কথা উল্লেখ করেন।


সমালোচনাঃ টলেমীর অবদানের উপর যে সব সমালোচনার সৃষ্টি হয়ে ছিল সেগুলো নিচে উল্লেখ করা হলঃ


১.  তিনি পৃথিবীর পরিধি ১৮০০০ মাইন ধরে ছিলেন, যা সঠিক নয়।


২.  তিনি নিরক্ষরেখাকে কিছু উত্তরে ধরায় অক্ষরেখা ও দ্রাঘিমা রেখার ভিডিতে যেন  সঠিক স্থানেরই অবস্থান পাওয়া যায়নি বনে পরিব্রাজকদের অসুবিধা হয়েছিন।

৩. পৃথিবীর প্রতি ডিগ্রীর সঠিক দূরত্ব ৫৯ মাইন কিন্তু টলেমীর মতে উহা ৫০ মাইল ছিল।

৪. তিনি ভারত সহাসাগরকে অনেক বড় করে দেখিয়েছিলেন।


৫. তিনি তাঁর মানচিত্রে আয়ারল্যান্ডকে ওয়েলসের উত্তরে দেখিয়ে হিস্ট কিছু প্রকৃত পক্ষে উহা পশ্চিম দিকে হবে।


৬. টলেমী তাঁর মানচিত্রে  দক্ষিণ মেরুকে দেখাতে পারেন নি ।এমন কি পৃথিবীর দক্ষিণাংশ সম্বন্ধে তাঁর কোন ধারণা ছিল না।


৭.  তিনি ভারত মহাসাগর বেষ্টনকারী টেরা অষ্টানিজ ভূখন্ডের কথা বলেছেন। কিন্তু বস্তুতপক্ষে এমন কোন ভূখন্ড নাই।


৮. তিনি পৃথিবীকে কেন্দ্রে রেখে গ্রহগুলো ও অন্যান্য নক্ষত্রগুলোকে যে ভাবে দেখিয়ে ছেন তা ঠিক নয়।


৯. টলেমী কোন দেশের আবহাওয়া, প্রাকৃতিক সম্পদ, অধিবাসী প্রভৃতি ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্য গুলোর ব্যাপারে নিরব ছিলেন।


১০. পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যবর্তী দূরত্ব টলেমীর হিসাব মতে অনেক কম ছিল এবং আমেরিকা ভূখন্ড সম্পূর্ণরূপে বাদ দেওয়া হয়েছিল।


১১. তিনি পূর্ব এশিয়া উপকূলকে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত করে টেরা অষ্টালিজ ইনকগনিটার সাথে যুক্ত করার ভারত মহাসাগর একটি হ্রদে পরিণত হয় কিন্তু  উহা বেষ্টিত সাগর নয়। আটলান্টিক ও প্রশান্ত মহাসাগরের সাথে শক্ত মহাসাগর।


উপসংহার: দূরবর্তী স্থানগুলোর তথ্য সংগ্রহ করা অসুবিধাজনক হওয়ায় ব্যক্তির দিক থেকে টলেমীর ভূগোল নিঃসন্দেহে অসম্পূর্ণ ছিল। তবুও নানাবিধ ত্রুটি-বিচ্যুতি থাকা সত্ত্বেও টলেমী একজন শ্রেষ্ঠ ভূগোলবিদ মানচিত্রবিদ ও জ্যোতির্বিদ ছিলেন। পূর্ব এশিয়া ও পশ্চিম ইউরোপের মধ্যবর্তী দূরত্ব সম্বন্ধে ভুল ধারণার ফলেই তের শত বছর পরেও টলেমীর তথ্যের উপর নির্ভর করে কলম্বাস স্পেন থেকে সরাসরি পশ্চিম দিকে ভারতে আসার সমুদ্র পথের অনুসন্ধান করে ছিলেন। মানচিত্রের উন্নয়নের জন্যে তিনি নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।



Post a Comment

0 Comments