হিন্দুধর্মে মাতা কেবল পরিবারের মমতাময়ী রক্ষক নন, তিনি দেবীর এক জীবন্ত প্রতীক। বেদ ও পুরাণে মাতৃরূপে দেবীকে শক্তি, জ্ঞান ও সমৃদ্ধির উৎস হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে—যেমন দুর্গা শক্তির প্রতীক, সরস্বতী জ্ঞানের আর লক্ষ্মী সমৃদ্ধির অধিষ্ঠাত্রী। ‘মাতৃ দেবো ভব’ এই বেদবাক্য মায়ের প্রতি ভক্তি ও শ্রদ্ধার গভীরতা প্রকাশ করে। সমাজেও মায়ের ভূমিকা শুধুমাত্র সন্তান পালন নয়, বরং নৈতিকতা, ধর্ম ও সংস্কারের প্রথম শিক্ষক হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ।
![]() |
সনাতন ধর্মে মায়ের স্থান |
হিন্দুধর্মে মাতা হচ্ছেন সেই শক্তি, যিনি ঘরে দেবী, সমাজে আদর্শ এবং আত্মিক জগতের প্রথম উপাস্য। প্রথমে ইন্ট্রোতে বলবো হিন্দুধর্মে মাতৃরূপী দেবীদের গুরুত্ব (দুর্গা, কালী ইত্যাদি)। তারপর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট - বেদ/পুরাণে মাতৃশক্তির উল্লেখ। সনাতন ধর্মে মায়ের গুরুত্ব ও স্থান সম্পর্কে তিনটি সহজ পর্যায় রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হয় তারপর আলোচনা করা হবে ধর্মীয় ভিত্তিতে মা ও বাবার গুরুত্ব ও স্থান কোথায়?
১. দেবী হিসেবে মাতা: সনাতন ধর্মে মাকে শুধু একজন জন্মদাত্রী হিসেবে নয়, বরং দেবীরূপে পূজিত করা হয়। মায়ের মধ্যে পরম করুণা, নিঃস্বার্থ ভালোবাসা এবং ত্যাগের যে গুণাবলি থাকে, তা দেবীত্বের প্রতীক। হিন্দু শাস্ত্রে বলা হয়েছে— "মাতৃদেবো ভব" অর্থাৎ মাকে দেবীর সমতুল্য জ্ঞান করো। দুর্গা, লক্ষ্মী, সরস্বতী— এই সকল দেবী রূপে মাতৃত্বের বৈশিষ্ট্যই প্রতিফলিত হয়েছে। মা সন্তানের জন্য যেমন ধৈর্য, ক্ষমা ও ভালোবাসার আদর্শ, তেমনি তিনি রক্ষাকর্ত্রী, পথপ্রদর্শিকা ও আশ্রয়দাত্রী। তাই মায়ের সেবাকে ধর্মজ্ঞান করা হয় এবং তাঁর আশীর্বাদকেই জীবনের সর্বোচ্চ সম্পদ মনে করা হয়। একজন মায়ের ছায়ায়ই একজন সন্তান জীবনের প্রকৃত শিক্ষা ও নৈতিকতা লাভ করে। দেবী রূপে মাতা: সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংসের অধিষ্ঠাত্রী — হিন্দুধর্মে মাতা শুধু করুণাময়ী নয়, তিনি মহাশক্তির আধার। দেবী দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী ও সরস্বতীরূপে মাতা সৃষ্টি, পালন ও ধ্বংস—এই তিনটি বিশ্বচক্রেরই প্রতীক। যেমন, দেবী সরস্বতী জ্ঞানের মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা করেন, লক্ষ্মী তা বজায় রেখে পালন করেন, আর দুর্গা ও কালী অশুভ শক্তির ধ্বংস করে ন্যায়ের প্রতিষ্ঠা ঘটান। এইভাবে মায়ের রূপ শুধুমাত্র স্নেহময় নয়, বরং শক্তিসম্পন্ন, ন্যায়পরায়ণ ও বিশ্বশক্তির আধার। তাই হিন্দুধর্মে মাতা একাধারে জন্মদাত্রী, পথপ্রদর্শক এবং সর্বশক্তিমান দেবীর মূর্ত রূপ।
২. পারিবারিক মাতৃভূমিকা: পরিবারে মায়ের ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও বহুমাত্রিক। তিনি শুধু একজন সন্তানের জন্মদাত্রী নন, বরং পরিবার গঠনের মূল ভিত্তি। মা সংসারের হৃদয়স্বরূপ—তিনি স্নেহ, মমতা, ত্যাগ ও সাহসের মূর্ত প্রতীক। সংসারের প্রতিটি সদস্যের দেখভাল, আবেগ-ভালোবাসার বন্ধন রক্ষা এবং পারিবারিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় মায়ের অবদান অসামান্য। তিনি সন্তানদের শিক্ষাদীক্ষা, নৈতিকতা ও মানবিক গুণাবলির প্রথম শিক্ষক। কঠিন সময়ে সাহস জোগানো এবং সুখের মুহূর্তে আনন্দ ভাগ করে নেওয়ার মানুষটিও তিনি। মায়ের কাঁধে ভর করেই একটি পরিবারে শান্তি, স্থিতি ও মানবিকতার পরিপূর্ণ বিকাশ ঘটে। তাই বলা হয়, একটি সুস্থ পরিবার গঠনে মায়ের অবদান অনন্য ও অতুলনীয়।
৩. আধুনিক সমাজে প্রাসঙ্গিকতা: আধুনিক সমাজে যান্ত্রিকতা, প্রযুক্তির প্রভাব ও দ্রুত পরিবর্তনের মধ্যেও পারিবারিক, নৈতিক ও সামাজিক মূল্যবোধের গুরুত্ব অটুট রাখতে হলে কিছু চিরন্তন আদর্শ ও সংস্কৃতির প্রাসঙ্গিকতা আজও অপরিহার্য। মানবতা, সহমর্মিতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও নৈতিক শিক্ষা—এই গুণগুলো আধুনিক সমাজে টিকে থাকার ভিত্তি। যদিও প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, তবুও মানুষের মধ্যে দূরত্ব ও বিচ্ছিন্নতা বাড়ছে। এই বাস্তবতায়, পারিবারিক বন্ধন, মা-বাবার প্রতি কর্তব্য, এবং সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের মতো মূল্যবোধ আরও বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। আধুনিক সমাজের ভারসাম্য রক্ষা ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে এই আদর্শগুলোকে অগ্রাধিকার দেওয়া একান্ত প্রয়োজন।
শাস্ত্রীয় উদ্ধৃতির মা এর মর্যাদার সঠিক রেফারেন্স
হিন্দু ধর্মে মায়ের স্থান অনেক উঁচু ।চণ্ডীতে স্তব মন্ত্রে বলা হয়েছে
“যা দেবী সর্বভূতেষু মাতৃরূপেণ সংস্থিতা” ।
আর সন্তান এর কাছে মায়ের স্থান কোথায় হবে সে বিষয়ে হিন্দু শাস্ত্রে সুস্পষ্ট নির্দেশ রয়েছে । সে বিষয়ে জানতে আমরা মনু সংহিতা্র একটি শ্লোক দেখব-
উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচার্য্যণাং শতং পিতা ।
সহস্রন্ত্ত পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে ।। মনুসংহিতা, ২/১৪৫
অনুবাদঃ "একজন আচার্যের গৌরব বেশি দশজন উপাধ্যায়ের তুলনায় ; পিতার মর্যাদা বেশি একশো আচার্যের তুলনায়; আর মাতা অধিক শ্রদ্ধার যোগ্য সহস্র পিতার থেকেও ।"
সন্তান শত সহস্র জন্ম নিলেও পিতা-মাতার ঋণ কখনও শোধ করতে পারে না।
যংমাতাপিতরৌ ক্লেশং সহতে সম্ভবে নৃণাম্ ।
নতস্য নিষ্কৃতিঃশক্যা কর্তুংবর্ষশতৈরপি ।। মনুসংহিতা, ২/২২৭,
অনুবাদঃ
সন্তান জননে পিতামাতা যে ক্লেশ সহ্য করেন পুত্র শত শত বৎসরে, শত শত জন্মেও সেই ঋণ পরিশোধ করতে সমর্থ নয় । এ ছাড়া শাস্ত্রে আরও বলা হয়েছে মাতৃভক্তি দ্বারা এই ভূলোক জয় করা সম্ভব ।
ইমং লোকং মাতৃভক্ত্যা … মনুসংহিতা, ২/২৩৩
অনুবাদ :
এই ভূলোক জয় করতে পারে মানুষ মাতৃভক্তি দ্বারা।
খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথাটি রামায়ণে ভগবান রামচন্দ্র বলেছিলেন-
জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরিয়সী।
এই সকল শাস্ত্রবাক্য থেকে সহজেই অনুধাবন করা যায়, সনাতন ধর্মে মায়ের স্থান কত উচ্চতর। তাই প্রত্যেক সন্তানের উচিত, নিজের জন্মদাত্রী মাকে সর্বোচ্চ সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানো।
আমাদের এই দেশে একটি সংখ্যালঘু ধর্ম হলো হিন্দু ধর্ম। এই ধর্মে নারীদের অবস্থান বহু যুগ ধরেই ছিল অবহেলিত ও অধিকারবঞ্চিত। নারীরা বিবাহের পর যদি স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হতেন, তবুও তাদের বিচ্ছেদের কোনো আইনগত সুযোগ ছিল না। বরং আজীবন স্বামীর পদসেবিকা হিসেবেই বিবেচিত হতেন। উত্তরাধিকার সূত্রে কোনো সম্পত্তির অধিকারও নারীদের ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর নারীর সতীত্ব প্রমাণ করতে স্বামীর চিতায় আত্মবলি দেওয়াকে বাধ্যতামূলক মনে করা হতো।
এমনকি বর্তমানে, যদি কোনো নারী কম বয়সে বিধবা হন, তবে তার পূর্ণ বিবাহের অধিকার এখনো বহু ক্ষেত্রেই স্বীকৃত নয়। বিবাহের সময় নারীরা বাবার বাড়ি থেকে যে সম্পদ নিয়ে শ্বশুরবাড়িতে যান, তার পর তারা আর সেই বাবার বা ভাইয়ের সম্পদের ওপর অধিকার রাখতে পারেন না।
হিন্দু ধর্মে নারীর অধিকার বলতে কিছু ছিল না। পুরুষেরা একাধিক স্ত্রী রাখতে পারলেও নারীদের সেই অধিকার ছিল না। তালাকের কোনো স্বীকৃতি না থাকায় নারীরা স্বামীর দ্বারা নির্যাতিত হলেও সম্পর্ক ছিন্ন করতে পারতেন না। যত কষ্টই হোক, তাকে স্বামীর গৃহেই জীবন অতিবাহিত করতে হতো। সমস্ত ক্ষমতা ছিল পুরুষের হাতে, নারীর স্বাধীনতা ছিল প্রায় নিষিদ্ধ।
তবে সনাতন ধর্মে মাতৃত্ব ও নারীর অবস্থান একেবারেই ভিন্ন। এখানে মা–একটি পবিত্র রূপ, শ্রদ্ধার প্রতীক। দেবতাদের চেয়েও দেবীর প্রাধান্য এখানে বেশি। "যা দেবী সর্বভূতেষু" – এই চণ্ডীপাঠের শ্লোক সনাতন সমাজে নারীর অবস্থানের প্রতিচ্ছবি। তাই হিন্দুদের ঘরে পূজারত নারী যখন গৃহলক্ষ্মী রূপে বিরাজ করেন, তখন অন্য পুরুষ গৃহকোণে অলক্ষ্মীরূপে স্থবির।
আমার ‘মা’ নামে একটি কাব্যগ্রন্থ আছে, প্রকাশিত হয়েছিল ২০০০ সালে। তাতে “মন্দাকিনী” নামের একটি কবিতা উৎসর্গ করেছি আমার প্রিয় বন্ধু অপূর্ব ভট্টাচার্যের মায়ের অকাল মৃত্যুতে।
সনাতন ধর্মে মনু স্মৃতিতে বলা হয়েছে:
“উপাধ্যায়ান্ দশাচার্য্য আচায্যাণাং শতং পিতা।
সহস্রন্তু পিতৃন্মাতা গৌরবেণাতিরিচ্যতে”
(মনু, ২/১৪৫)
– অর্থাৎ, দশজন উপাধ্যায় অপেক্ষা একজন আচার্য, একশ আচার্যের চেয়ে পিতা, আর সহস্র পিতার চেয়েও মাতার মর্যাদা অধিক।
কি অতুলনীয় শ্লোক! কী অসাধারণ বাণী! আমাদের সন্তানেরা যদি এ শিক্ষা গ্রহণ করে, তাহলেই সমাজ হবে মানবিক ও মহীয়ান।
হিন্দু ধর্মে মায়ের স্থান সর্বোচ্চ এবং অত্যন্ত গৌরবময়। এখানে মাকে শুধু জন্মদাত্রী হিসেবে নয়, বরং দেবী ও শক্তির প্রতীক রূপে পূজিত করা হয়। মায়ের মাধ্যমে জীবনের শুরু, আর তাঁর স্নেহ, ত্যাগ ও শাসনের মাধ্যমেই সন্তানের চরিত্র গঠিত হয়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে—"মাতৃ দেবো ভব" অর্থাৎ মাকে দেবীর মতো পূজা কর। দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী ও সরস্বতীরূপে মাতৃশক্তিকে কেন্দ্র করে হিন্দু ধর্মে নারীর যে সম্মান ও গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে, তা পৃথিবীর অন্য কোনও ধর্মে এত ব্যাপকভাবে দেখা যায় না। তাই হিন্দু ধর্মে মায়ের মর্যাদা শুধু পারিবারিক নয়, বরং আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক স্তরেও অতুলনীয়।
0 Comments