সভ্যতা হল মানুষের সামগ্রিক জীবনাচরণের সমষ্টি। তাদের জীবনাচরণ সমষ্টির বর্হিপ্রকাশ হল সংস্কৃতি। আর সংস্কৃতির চরম উৎকর্ষতার চূড়ান্ত রূপ হল সভ্যতা। সত্যতা একটি জটিল প্রক্রিয়া। মানুষের নানাবিধ উন্নত আচরণের বা কর্মকান্ডের দ্বারা সভ্যতা বিকশিত হয়ে থাকে।
![]() |
নীলনদ সভ্যতার ছবি |
সভ্যতা শব্দটির উৎপত্তিঃ ইংরেজী 'civilization' শব্দের বাংলা প্রতিশব্দ হল সভ্যতা। civilization শব্দটি civics বা civitus শব্দদয় থেকে এসেছে। civics শব্দের অর্থ হল নাগরিক। অর্থ্যা নাগরিকের দ্বারা যখন উন্নত জীবনব্যবস্থা স্থাপিত হয় তখন তা সভ্যতা হিসাবে অভিহিত হয়। ফরাসী দার্শনিক ভলটেয়ার সর্বপ্রসম civilization' শব্দটি ব্যবহার করেন।
সভ্যতার প্রামাণ্য সংজ্ঞাঃ বিভিন্ন সমাজবিজ্ঞানী, প্রত্নতত্ত্ববিদ ও দার্শনিক সজরাকে বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে সংজ্ঞায়িত করেছেন।
১. সমাজবিজ্ঞানী Moryan টার Ancient Society" গ্রন্থি বলেছেন," সজল হচ্ছে বিবর্তন নামক সিঁড়ির শেষ ধাপ।"
২.সমাজবিজ্ঞানী "ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, " মানুষ তার জীবনধর্ষণ ব্যবস্থা। নিয়ন্ত্রন কম্পো যে প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা বা সংগঠন সৃষ্টি করেছে তারই সার্টিফ ররূপ হল সভ্যতা
৩.নৃবিজ্ঞানী F. B: Taylor বলেন, " সভ্যতা বলতে এমন সংস্কৃতিকে বুঝায় যা সাধারণত নগর বা শহরে জীবনের বৈশিষ্ট্যকে স্পর্শ করে।
৪.পাসকুলার জিসকার্টের মতে, সভ্যতা হচ্ছে সংস্কৃতির সেই সকল স্তর যেখানে একটি উন্নত ও মিশ্র সমাজে লোকজনের সমাবেশ সৃষ্টি করেছে- অর্থী নগরের রূপ নাও করেছে।
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোলবিদ অধ্যাপক লুম্মিল হক বলেন," আমরা যা কিছু করি তা আমাদের সংস্কৃতি আর এই সংস্কৃতির চূড়ান্ত বা উৎকৃষ্ট রূপ হলা সভ্যতা।
উপরের সংজ্ঞা গুলোর আলোকে সত্যতার সাধারণ সংজ্ঞায় বলা যায় যে, সভ্যতা হচ্ছে মানুষের আচরণ তথা সার্বিক কর্মকাণ্ডয় উন্নতরূপ যা সংস্কৃতির ধারক ও বাহক।
মিশরীয় না নীলনদ সভ্যতাঃ নদীকে কেন্দ্র করে যেসব সভ্যতা গড়ে উঠেছিল মিশরীয় বা নীল সভ্যতা তার মধ্যে অন্যতম আকর্ষনীয় সভ্যতা। ইতিহাসের জনক গ্রীক ইতিহাসবিদ হেরোডোটাস নীল নীলনদ সভ্যতা দর্শন করে হতবাক হয়েছিলেন। খ্রীস্টপূর্ব প্রায় ৫ হাজার বছর পূর্বে মিশরের নীলনদের অববাহিকায় এ সভ্যতা- গাড়ে উঠেছিল।
মিশরীয় সভ্যতার স্থিতিকালঃ প্রত্নতত্ত্ববিদগণ মিশরীয় সভ্যতার স্থিতিকাল বা সময়কালকে, তিন ভাগে ভাগ করেছেন। খ্রিস্টপূর্ব ২৯৫০ অব্দ থেকে ২১০০ অব্দ পর্যন্ত পুরাতন যুগের রাজত্বকাল। খ্রীস্টপূর্ব ২১০০ থেকে ১৭০০ অব্দ পর্যন্ত সর্বযুছার রাজত্বকাল। খ্রিস্টপূর্ব ১৭০০ থেকে ১১০০ অব্দ পর্যন্ত নতুন যুগের রাজত্বকাল। এ সময়ে। সম্রাটই ছিলেন সর্বময় কর্তা। ফারান্ড সম্রাটেরা ৫০০ বছর এখানে রাজত্ব করেছিল।
রাজনৈতিক অবস্থাঃ ৩,২০০ খ্রীস্ট পূর্বাব্দের আগে দ্বন্দ্বরত উপজাতি বিশিষ্ট্য গ্রামগুলোর শাসনভার দুই রাজার অধীনে ছিল। প্রাচীন মিশরে রাজাকে ফারাও বলা হত। ঐতিহাসিকরা প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার ইতিহাসকে ৩২টি রাজবংশের রাজত্ববান অনুসারে ভাগে ভাগ করেছেন।
যেমন-
১. ২৯৫০ থেকে ২৭৫০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল প্রথম ও দ্বিতীয় রাজবংশের রাজত্বকাল এবং আদের রাজধানী ছিল মেমস্কিস।
২. ২৭৫০ থেকে ২৪০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কে পুরানের যুগের রাজত্বকাল বলা হয়।
৩. ২৪০০ থেকে ২০৬০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত সময়কাল ছিল সপ্তম থেকে দশম বংশের অধীনেই।
৪. ২০৫০ থেকে ১৭৮৮ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত দ্বাদশ রাজবংশের রাজত্বকাল এবং ১৭৮৮ থেকে ১৫৮০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত এয়োদশ থেকে সপ্তদশ রাজবংশের রাজত্বকাল ছিল।
৫. ১৫৮০ থেকে ১১০০ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত স্থায়ী রাজত্ব কালকে নতুন যুগের রাজত্ব' বলা হয়। এসময় ১৮ থেকে ২০ ৩ম রাজবংশ রাজত্ব করে এবং রাজারা ফারাও উপাধি লাভ করে।
৬. ১১০০ থেকে ৯৪৫ খ্রীঃ পূর্বাব্দ পর্যন্ত ২১তম রাজবংশ এবং ৯৪৫ খেতে ৫২৫ খ্রীঃ পূর্বাঙ্গ পর্যন্ত আরও ৫টি রাজবংশ রাজত্ব করে।
সামাজিক অবস্থাঃ উক্ত সময়কালীন মিশরো সমাজ কাঠামোকে প্রধানত তিনটি শ্রেনীতে বিভক্ত করা হয় । যথাঃ---
১. রাজ্য, রাজ, দরবারের গণ্যমান্য ব্যক্তি, পুরোহিত, ভূমির মালিক ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে উচ্চ শ্রেণী।
২. বণিক, কারিগর ও অন্যান্য শ্রম শিল্পীদের নিয়ে মধ্যম শ্রেণী।
৩. ভূমিদাস, সেবাদাস, ক্রীতদাস. ছিল নিম্নশ্রেণী ভুক্ত। ঐ সময়ে সমাজে জীবনে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা ছিল। মিশরের-রানীকে দেবতার আসনে বসানো হত বলে মেয়েরা সম্মান পেত অর্থাৎ পারিবারিক ও সামাজিক জীবন যাপন ছিল অত্যন্ত সুখের।
শাসন ব্যবস্থাঃ দেবতা-রাজা সমগ্র জাতির অধিশ্বর দিলেন। রাজা, সরকারের অনেক কর্তব্য সাধারণ মানুষের উপর অর্পন করতেন। রাজার কাছ থেকে মন্ত্রী ও প্রশাসকদের মাধ্যমে নগর পালনদের উপর ক্ষমতা ন্যস্ত করা হয়েছিল। এভাবে মিশারে সর্বপ্রথম কেন্দ্রীভূত আমলাতন্ত্রের উদ্ভব হয় । রাজা ছিলেন জনগণের কাছে একাধারে দেবতা, শাসক, প্রধান বিচারক, প্রধান সেনাপতি ও প্রধান ধর্মীয় নেতা। কোন লিখিত আইন যাইন ছিল না। রাজার কথাই সব।
অর্থনৈতিক অবস্থাঃ প্রাচীন মিশরীয় সভ্যতার অর্থনীতির প্রধান উৎস ছিল কৃষি। এখানে সামন্ত পদ্ধতিতে উৎপাদন হত। অর্থাৎ ভূমি দাসেরা কৃষিকাজ করতো এবং মনিবগন উৎপাদিত ফসল ভোগ করতো। নীলনদের বন্যার ফলে মিশরের কৃষি ভূমি ছিল উর্বর। তাই প্রচুর পরিমাণে গম, যব, জোরার, প্রভৃতি উৎপন্ন হতো। মিশরের রাজা দিলেন জমির মালিক। শ্রেণী প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত থেকে মানুষেরা স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতো।
পোশাক পরিচ্ছদ ও অন্যান্য প্রসাধনীঃ নীলনদের আদিবাসীদের পোশাক পরিচ্ছদ দিল অত্যন্ত সাদামাটা। প্রথম অবস্থায় উচ্চ শ্রেণীর লোকেরা নাইলন জাতীয় কাপড় ব্যবহার করতো এবং নিম্ন শ্রেনীর লোকেরা প্রায় উলঙ্গ অবস্থায় থাকতো। পুরুষদের চেয়ে মহিলারা কাপড় বেশী ও ব্যবহার করতো। সম্ভ্রান্ত পরিবারের পুরুষ ও মহিলারা অলংকার ব্যবহার করতো। মহিলারা প্রসাধনী ও সুরভিত দ্রুত সেহার করতো।
ভাষা ও নিখন পদ্ধতিঃ ঐ সময়ে মিশরীয়রা সেমিটি ভাষায় কথা বলতো । মনের ভাব ও ধ্যান-ধারণা প্রকাশের জন্য লিখন পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়। আবিষ্কৃত বর্ণমালার মধ্যে স্বরবর্ণ না থাকায় শব্দ উচ্চারণ করা কষ্ট হতো। তাদের বর্ণমালাকে হায়ারে গ্লোসিক' বা পবিত্র বর্ণমালা বলা হতো। এছাড়া তার ছবির প্রতীকের সাহায্যেও ভাবের আদান-প্রদান করতো।
![]() |
মিশরীয় সভ্যতার ছবি |
জ্ঞান বিজ্ঞানঃ ঐ সময়ে মিশর জ্ঞান-বিজ্ঞানে যাই উন্নত ছিল। যেমন-স্থাপত্য বিদ্যা, বলবিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, গণিত ও স্থাপত্যবিদ্যা, বলবিদ্যা, প্রকৌশল বিদ্যা, চিকিৎসা বিদ্যা, গণিত ও জ্যোতিবিদ্যায় ব্যাপক উন্নতি লাভ করেছিলেন। তারা চন্দ্রমাস হিসাবে বছর গগনা করতো এবং দিনকে সমান ১২ ঘণ্টা করে ভাগ করেছিলো। তারা বিভিন্ন গ্রহ ও নক্ষত্রের গতিবিধি লক্ষ্য করলে মানুষের ভালমন্দ সম্পর্কে পূর্বাভাস দিতো।
চিকিৎসা বিজ্ঞানঃ চিকিৎসা ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় ও তার সমাধান দিবার ব্যবস্থা করতে অবস্থা করতো। ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগানোর ক্ষেত্রে ভেষজ ঔষধ প্লাস্টার ব্যবহার করতো। ভেষজ ঔষধ ব্যবহার করতো। মৃত মানুষের দেহকে মমি করে রাখার জন্য ভেষজ ওষুধ ব্যবহার করত।
শিল্প প্রতিষ্ঠানঃ এ সময় ধাতুর সাহায্যে নানা প্রকার প্রকার অলংকার ও বাসসপত্র তৈরী করা হতো। সোনা, তামা, ব্রোঞ্জ ও মাটি দিয়ে বিভিন্ন আকর্ষণীয় অলংকার অস্ত্র ও বাসনপত্র তৈরি করা হতো। বয়ন শিল্পে সুতী, পশমি নিলেন, নাইনোন কাপড় বুনা হতো।
চিত্র অংকন: ঐ সময়ের শিল্পীরা চিত্র অংকনে বেশ পারদর্শী ছিল। সমাধি, স্মৃতিস্তম্ভ ও মন্দিরগুলোর দেয়ালে রঙিন ছবি আঁকা হতো।
ধর্মীয় ব্যবস্থাঃ প্রথম দিকে মিশরীয়রা বাতাস, পানি, গাছ জীবজন্ত প্রকৃতির মধ্যে দেবতাদের উপলব্ধি করতো। তাদের মধ্যে টোটেম বিশ্বাস বিদ্যমান ছিল। দেবতাদের মধে হোরাম, ওসিরিস, জের, নাট ফারাড উল্লেখযোগ্য।মিশরীয়দের ধর্মীর বিশ্বাস ছিল যে, প্রাণের মৃত্যু হয়না, আত্মা-অবিনশ্বর।
উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিঃ মিশরীয়দের উল্লিসযোগ্য সৃষ্টির মধ্যে মমি, পিরামিড ও ভাস্কর্য উল্লেখযোগ্য।
মমিঃ মিশরিয়রা তাদের দেবতাদের আত্মাকে ধরে রাখার জন্য মৃতদেহাকে অধিকৃত রাখার জন্যা মমিকৃত করে রাখতো।
পিরাপিডঃ মমি যাতে সহজে নষ্ট না হয় তার জন্য তারা বিশেষ ব্যবস্থায় যত্নসহ বিশাল ও সুউচ্চ পিরামিড তৈরি করতো। খুফুর পিরামটি সবচেয়ে বড়।
ভাস্কর্যঃ প্রাচীন মিশরীয়রা অত্যন্ত দক্ষতার সাথে খোদাই করে ফারাও ও সম্ভ্রান্ত লোকদের মূর্তি তৈরী করতো। স্ফিংস নামে পরিচিত সিংহের দেহ ও মানুষের মাথা বিশিষ্ট মূর্তি তাদের ভাস্কর শিল্পের উল্লেখযোগ্য নিদর্শন।
উপসংহারে বলা যায় যে, প্রাচীনকাল যত সভ্যতা গড়ে উঠেছিল তার প্রায় সবই নদী তীরবর্তী। আর এই নদী তীরবর্তী সত্যতা হিসারে মিশরীয় সভ্যতা বা নীলনদ সভ্যতা দিন সম-সাময়িকক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞান, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সামাজিক ভাবে সবচেয়ে সুপ্রতিষ্ঠিত সভ্যতা। তাই এই সভ্যতার নিদর্শন আজও আমাদেরকে বিস্মিত করে তোলে।
0 Comments