কোন হিন্দু ধর্মগ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা হয়েছে?

এই প্রশ্নের উত্তর জানার জন্য আমাদের বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থের কথা জানতে হবে। তাই একটু সময় দিয়ে এই পোস্টটি পড়ুন। আশা করি, এই পোস্টের পর হিন্দু ধর্মের লোকেরা মাথা নিচু করে থাকার প্রয়োজন বোধ করবেন না। আপনি আর্য সমাজী এবং অন্য ধর্মের মানুষের কাছে গর্বিতভাবে মাথা উঁচু রাখতে পারবেন।

ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের ছবি
ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণের ছবি

প্রত্যেক সনাতনী যখন এই বিষয়ে কথা বলবে, তারা বিশ্বাসের সঙ্গে বলতে পারবেন যে শ্রীকৃষ্ণই ঈশ্বর। আজকাল অনেকেই শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর মানতে চান না, এমনকি কিছু হিন্দুও মানতে অস্বীকার করেন। তারা গীতায় শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বর হওয়ার কথা বোঝাতে চান না। তারা বলেন গীতা শ্রীকৃষ্ণের কথা নয় কিংবা শ্রীকৃষ্ণকে কোথাও ঈশ্বর বলা হয়নি ইত্যাদি নানা অযৌক্তিক কথা বলে।

এখানে গীতা এবং পুরাণ ছাড়া অন্য কিছু ধর্মগ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা হয়েছে সেগুলো আলোচনা করছি। ঈশ্বর সর্বশক্তিমান। তিনি একদিকে নিরাকার, অন্যদিকে সাকার। শ্রীবিষ্ণু এবং শ্রীকৃষ্ণ আলাদা নয়, শ্রীবিষ্ণুই শ্রীকৃষ্ণের রূপে এই পৃথিবীতে এসেছেন। শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা হয়েছে বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থে, যেমন ঋগ্বেদ, মহাভারত (পঞ্চম বেদ), ব্রহ্মসংহিতা। ফের শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতেও শ্রীকৃষ্টকে ঈশ্বর বলা হয়েছে, যদিও সেখানে কিছু ভুল তথ্য রয়েছে। 

হিন্দু ধর্মগ্রন্থে শ্রীকৃষ্ণকে পরমেশ্বর বা ঈশ্বর হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে গীতার বাইরেও অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থে। নিম্নে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রামাণিক উৎস ও শ্লোক দেওয়া হলো:

👉ঋগ্বেদে বলা হয়েছে----  

১| মূল মন্ত্র: "ইদং বিষ্ণুর্বিচক্রমে ত্রেধা নিদধে পদম্।

সমূলহনস্য পাংসুরে।।" (ঋগ্বেদ – ১/২২/১৭)

(শব্দার্থ):

  1. ইদং – এই

  2. বিষ্ণুঃ – পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণু

  3. র্বি – বিবিধভাবে

  4. চক্রমে – বিস্তার বা গঠন করিয়াছেন

  5. ত্রেধা – তিন প্রকারে

  6. নিদধে – প্রতিষ্ঠা বা স্থাপন করিয়াছেন

  7. পদম্ – পা

  8. সঃ – তিনি

  9. অস্য – এই (বিশ্বের)

  10. পাংসুরে – ধূলিকণায়

অনুবাদ: ভগবান শ্রীবিষ্ণু এই জগৎকে তিন প্রকারে বিবিধভাবে বিস্তার করেছেন। তিনি তাঁর ধূলিকণায় পরিপূর্ণ পাদপদ্ম দ্বারা এই সমগ্র সৃষ্টি জগতকে ধারণ বা প্রতিষ্ঠা করেছেন।

(আরও সহজভাবে): শ্রীবিষ্ণু এই বিশ্বজগতকে তিনভাবে বিস্তৃত করেছেন এবং তাঁর ধূলিতে আবৃত পায়ের স্পর্শেই এই জগৎ স্থিত রয়েছে। 

২| মূল মন্ত্র:

"ওঁ তদ্ বিষ্ণোঃ পরমং পদং সদা পশ্যন্তি সূরয়ঃ।
দিবীব চক্ষুরাততম্।।"

(ঋগ্বেদ – ১/২২/২০)

(শব্দার্থ):

  1. তদ্ – সেই

  2. বিষ্ণোঃ – পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর

  3. পরমং – পরম / সর্বোচ্চ

  4. পদং – পদ (এখানে অর্থ: স্থান বা অবস্থান)

  5. সদা – সর্বদা / সবসময়

  6. পশ্যন্তি – দর্শন করেন / দেখে থাকেন

  7. সূরয়ঃ – জ্ঞানী ও ধার্মিক ব্যক্তিরা

  8. দিবীব – দিব্যরূপে / ঈশ্বরীয়ভাবে

  9. চক্ষু – চোখ

  10. আততম্ – প্রসারিত / সূর্যের মতো বিকীর্ণ

অনুবাদ: জ্ঞানী ও ধার্মিক ব্যক্তি‌রা সর্বদা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সেই সর্বোচ্চ অবস্থান বা পরম স্থানকে দর্শন করেন, যেটি সূর্যের মতো দিব্যচক্ষুর মাধ্যমে প্রকাশমান হয়ে থাকে।

আরও সহজভাবে ব্যাখ্যা: ধার্মিক ও জ্ঞানীজনেরা দিব্য দৃষ্টিতে সর্বদা শ্রীবিষ্ণুর পরম অবস্থানকে দেখে থাকেন, যা সূর্যের মতো উজ্জ্বলভাবে বিকীর্ণ হয়ে থাকে।

👉মহাভারতে বলা হয়েছে----  

১|  যত্তৎপরং ভবিষ্যঞ্চ ভবিতব্যঞ্চ যৎপরম। 

ভুতাত্মা চ প্রভুশ্চৈব ব্রহ্মযচ্চ পরংপদম্।। 

তেনাস্মি কৃতসংবাদঃ প্রসন্নেনসুরর্ষভাঃ। 

জগতোহনুগ্রহার্থায় যাচিতো মেজগৎপতিঃ।। (মহাভারত- ৬/৬৫/৬-৭) (অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)  

অনুবাদঃ দেবশ্রেষ্ঠগণ! যিনি সবকিছুর উপরে, যিনি সব সময় ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন – তিনিই এই জগতের স্রষ্টা। তিনি দয়ালু হয়ে আমার সাথে কথা বললেন।

২| শ্লোক:

মানুষং লোকমাতিষ্ঠ বাসুদেব ইতি শ্রুতঃ।

অসুরাণাং বধার্থায় সম্ভবম্ভ মহীতলে।।

(মহাভারত – ৬/৬৫/৮)

(অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: আপনি পৃথিবীতে মনুষ্যরূপে আবির্ভূত হোন এবং "বাসুদেব" নামে প্রসিদ্ধ হোন। আপনার এই অবতারণার উদ্দেশ্য হবে অসুরদের বিনাশ সাধন।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকটি মহাভারতের একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে ব্রহ্মা কর্তৃক শ্রীবিষ্ণুর প্রতি উচ্চারিত। পৃথিবী যখন অসুর, অধর্ম এবং পাপের ভারে দুঃখ ভারাক্রান্ত, তখন ব্রহ্মা জগৎপতি শ্রীবিষ্ণুর নিকট প্রার্থনা করেন— তিনি যেন মানবরূপে অবতীর্ণ হন, অসুরদের বিনাশ করেন এবং ধর্মকে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। এখানে ব্রহ্মা স্পষ্ট করে বলেন, শ্রীবিষ্ণু 'বাসুদেব' নামে পরিচিত হন, যিনি পরে শ্রীকৃষ্ণ হিসেবে জন্ম নেন। এর মাধ্যমে বোঝা যায় যে, ভগবান শ্রীবিষ্ণুই শ্রীকৃষ্ণরূপে অবতীর্ণ হয়েছেন। তাই, এই শ্লোকটা পরিষ্কার করে বলে— শ্রীবিষ্ণু হলেন শ্রীকৃষ্ণ, আর শ্রীকৃষ্ণই পরমেশ্বর ভগবান।

৩| সংস্কৃত শ্লোক:

তস্যাহমগ্রজঃ পুত্রঃ সর্বস্য জগতঃ প্রভুঃ।

বাসুদেবোহর্চ্চনীয়ো বঃ সর্বলোকমহেশ্বরঃ।।

(মহাভারত – ৬/৬৫/১৩)

(অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: আমি (ব্রহ্মা) সেই সর্বজগতের প্রভু নারায়ণের জ্যেষ্ঠপুত্র। তাই সর্বলোকের মহান অধীশ্বর বাসুদেব (শ্রীকৃষ্ণ) একমাত্র পূজনীয়।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকে ব্রহ্মা নিজেকে পরমেশ্বর নারায়ণের জ্যেষ্ঠপুত্র বলে পরিচয় দিচ্ছেন। এটি তিনি এই কারণে বলেন যে, ব্রহ্মা হলেন দেবতা ও অসুরদের মধ্যকার সর্বপ্রথম সৃষ্ট জীব। বিষ্ণুর নাভিকমলে থেকে তাঁর উৎপত্তি। ব্রহ্মা স্বয়ং বিষ্ণুর আদেশে সৃষ্টি কার্য পরিচালনা করেন।এই সূত্রেই তিনি বলেন, "বাসুদেবই— অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই— সর্বলোকের মহান ঈশ্বর ও একমাত্র পূজনীয় দেবতা।" এখানে 'বাসুদেব' নামে শ্রীকৃষ্ণকে সম্বোধন করে ব্রহ্মা তাঁর সর্বোচ্চ ঐশ্বরিক অবস্থান ঘোষণা করেন। এছাড়াও, শ্রীকৃষ্ণ নিজেও গীতার বহু শ্লোকে (যেমন ৫/২৯ ও ৯/১১) স্পষ্টভাবে বলেছেন— তিনি সর্বভূতের ও সর্বলোকের প্রভু।

সুতরাং, এই শ্লোকটি স্পষ্ট করে দেয়—

👉 শ্রীকৃষ্ণই হলেন নারায়ণের স্বরূপ।

👉 তিনিই জগতের সৃষ্টিকর্তা, পালনকর্তা ও প্রভু।

👉 এবং তিনিই সর্বত্র পূজনীয় “পরমেশ্বর ভগবান”।


৪| সংস্কৃত শ্লোক:

তথা মনুষ্যোহয়মিতি কদাচিৎ সুরসত্তমাঃ।

নাবজ্ঞেয়ো মহাবীর্য্যঃ শঙ্খচক্রগদাধরঃ।।

এতৎ পরমকং গুহ্যমেতৎ পরমকং পদম্।

এতৎ পরমকং ব্রহ্ম এতৎ পরমকং যশঃ।।

(মহাভারত – ৬/৬৫/১৪–১৫)

(অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: হে দেবশ্রেষ্ঠগণ! কখনও এ মনে করো না— "তিনি কেবল একজন মানুষ।" কারণ তিনি মহাশক্তিধর, শঙ্খ-চক্র-গদাধারী পরমনারায়ণ। তাঁকে অবজ্ঞা করো না। তিনিই পরম গুহ্য তত্ত্ব, তিনিই পরম ধাম (গন্তব্য), তিনিই পরম ব্রহ্ম, এবং তিনিই পরম যশের অধিকারী।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকের মাধ্যমে ব্রহ্মা দেবগণকে সতর্ক করছেন— তারা যেন শ্রীকৃষ্ণকে কেবল একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে না দেখেন। কারণ তিনি বহিরঙ্গে মানবরূপ ধারণ করলেও, অন্তরে তিনি পরমেশ্বর স্বয়ং। তিনি অসীম শক্তির আধার, তাঁর হাতে শঙ্খ, চক্র ও গদা— যেগুলি বিষ্ণুর চিহ্ন।

তাঁকে উপলব্ধি করা সহজ নয়, কারণ তিনি স্বয়ং পরম গোপন তত্ত্ব (গুহ্যতম সত্য)।

তিনিই পরম পদ, যেখানে আত্মা চূড়ান্তভাবে বিশ্রাম পায়।

তিনিই ব্রহ্ম— অদ্বিতীয়, অনন্ত, সর্বব্যাপী চৈতন্য।

এবং তিনিই যশের সর্বোচ্চ স্তম্ভ, যাঁর গৌরব সীমাহীন।

অর্থাৎ, শ্রীকৃষ্ণ বা বাসুদেবকে কেবল মানব রূপে বিচার করা মহাভুল। তিনি মানবরূপে অবতীর্ণ হলেও, তিনি পরমেশ্বর ভগবান শ্রীবিষ্ণুর স্বরূপ।


৫| তস্মাৎ সেন্দ্রৈঃ সুবৈঃ সর্বৈর্লোকৈশ্চামিতবিক্রমঃ।

 নাবজ্ঞেয়ো বাসুদেবো মানুষোহয়মিতি প্রভুঃ।। 

যশ্চ মানুষমাত্রোহয়মিতি ব্রূয়াৎ স মন্দধীঃ। 

হৃষীকেশমবিজ্ঞানাত্তমাহুঃ পুরুষাধমম্।। (মহাভারত- ৬/৬৫/১৮-১৯) (অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)  

অনুবাদঃ অতএব "অমিতবিক্রমশালী ও জগদীশ্বর এই বাসুদেবকে (শ্রীকৃষ্ণকে)" মানুষ মনে করিয়া ইন্দ্র প্রভৃতি দেবতারা কিংবা অন্যান্য লোকেরা যেন ইহাকে অবজ্ঞা না করেন। যে লোক অজ্ঞানবশতঃ এই "হৃষীকেশকে (শ্রীকৃষ্ণকে)" মানুষমাত্র বলিবে সে মন্দবুদ্ধি, সকলে তাকে "পুরুষাধম" বলিবে।  


৬| সংস্কৃত শ্লোক:

সারথ্যমর্জুনস্যাজৌ কূর্ব্বনু গীতামৃতং দদৌ।

লোকত্রয়োপকারায় তস্মৈ ব্রহ্মাত্মনে নমঃ।।

(মহাভারত – ১২/৪৬/১০৬ (অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: যিনি মহাযুদ্ধে অর্জুনের সারথি রূপে আবির্ভূত হয়ে, ত্রিভুবনের কল্যাণার্থে অর্জুনকে “গীতার অমৃত জ্ঞান” প্রদান করেছেন, সেই পরম ব্রহ্ম, সেই স্বয়ং ঈশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে আমি প্রণাম জানাই।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকটি শ্রীকৃষ্ণের ঈশ্বরত্ব প্রতিষ্ঠার একটি অত্যন্ত শক্তিশালী প্রমাণ। এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে— যিনি কুরুক্ষেত্রের রণভূমিতে অর্জুনের সারথি হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, তিনিই অর্জুনকে গীতার জ্ঞান দান করেন এবং এই গীতাজ্ঞান শুধুমাত্র অর্জুনের জন্য নয়, বরং সমস্ত ত্রিলোকের (স্বর্গ, মর্ত্য ও পাতাল) মঙ্গলের জন্যই দান করা হয়েছিল। এখানে শ্রীকৃষ্ণকে শুধুমাত্র "গীতার বক্তা" হিসেবে নয়, বরং "পরম ব্রহ্ম" ও "ঈশ্বর" হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।সুতরাং, যিনি সারথি হয়েছিলেন— তিনি যদি একজন সাধারণ মানুষ হতেন, তবে তাঁকে কখনোই ব্রহ্মাত্মা, পরমেশ্বর বা লোকত্রয়ের উপকারক বলে চিহ্নিত করা হতো না। তদ্ব্যতীত, এই শ্লোক এমন লোকদের যুক্তিহীন দাবি খণ্ডন করে, যারা বলেন—"শ্রীকৃষ্ণ ছিলেন শুধুই একজন মহাপুরুষ", বা "তিনি যোগযুক্ত হয়ে ঈশ্বরের বার্তা দিয়েছিলেন।"

কিন্তু শ্লোকটি স্পষ্ট জানায়:

👉 "সেই শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং গীতা বলেছেন" — তিনি কারো যোগে বলননি।

👉 "সেই সারথি স্বয়ং পরম ব্রহ্ম" — অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণই পরমাত্মা।

👉 "তিনি নিরাকার নন, সাকার স্বরূপেই অবতীর্ণ হয়েছিলেন।"

সুতরাং, যদি শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর না হতেন, বা যদি তিনি কেবল একজন মানুষ হতেন, তবে এই শ্লোক মহাভারতের মতো মহাগ্রন্থে স্থান পেত না। এছাড়াও, গীতার নিজস্ব শ্লোক (যেমন ১০/২০, ৯/১১, ৭/৭) ও বহু পুরাণেও তিনি নিজেকে পরমেশ্বর রূপেই প্রকাশ করেছেন।

অতএব, এই শ্লোক অকাট্যভাবে প্রমাণ করে—

👉 শ্রীকৃষ্ণই “পরম ব্রহ্ম”, “পরমেশ্বর”, “জগদীশ্বর”।

👉 তিনি কোনো সাধারণ মানুষ নন, তিনিই স্বয়ং ভগবান।  

৭| সংস্কৃত শ্লোক:

ত্বং হি কর্ত্তা হৃষীকেশ! সংহর্ত্তা চাপরাজিতঃ।

নহিপশ্যামি তেভাবং দিব্যংহিত্রিষু বর্ত্মসু।।

(মহাভারত – ১২/৪৬/১১৮)

(অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: হে হৃষীকেশ (শ্রীকৃষ্ণ)! আপনি এই সৃষ্টির কর্তা ও সংহারকারী এবং আপনি কখনও পরাজিত হন না। কিন্তু আমি বিস্ময়ের সঙ্গে দেখি— জ্ঞান, কর্ম ও ভক্তি— এই তিনটি সাধনার পথের মধ্যেও আমি আপনার সেই অপার, দিব্য স্বরূপকে সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারছি না।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকটি একজন যোগ্য উপলব্ধিকারীর গভীর হৃদয়বেদনা ও ঈশ্বরীয় রহস্য উপলব্ধির অসীম গভীরতা প্রকাশ করে।

এখানে বলা হচ্ছে—

শ্রীকৃষ্ণই হচ্ছেন এই জগতের স্রষ্টা (কর্ত্তা), সংহারকারী (সংহর্ত্তা), এবং তিনি অনন্য, অপরাজেয়।

তাঁর হাতে জগৎ সৃষ্টি হয় এবং তাঁর ইচ্ছাতেই জগৎ বিলীন হয়। তবুও, জ্ঞান (বিবেক ও দর্শনচিন্তা),

কর্ম (কর্তব্যপালন), ভক্তি (ভগবানের প্রতি প্রেম ও শরণাগতি)—এই তিনটি যোগপথ অনুসরণ করেও তাঁর দিব্য ভাব বা প্রকৃত ঈশ্বরত্ব সম্পূর্ণরূপে উপলব্ধি করা যায় না।

এখানে এক গভীর সত্য প্রকাশ পেয়েছে—

শ্রীকৃষ্ণের দিব্যতা কেবল বুদ্ধি বা ক্রিয়া দিয়ে নয়, চিত্তের শুদ্ধতা, আত্মসমর্পণ এবং তাঁর কৃপার মাধ্যমেই উপলব্ধি করা যায়। অর্থাৎ, তিনি ইন্দ্রিয়াতীত, যুক্তিতীত, কিন্তু প্রেমেতীত নন।

৮| সংস্কৃত শ্লোক:

তচ্চ পশ্যামি তত্ত্বেন যত্তপ রূপং সনাতনম্।

দিবং তে শিরসা ব্যাপ্তং পদ্ভ্যাং দেবী বসুন্ধরা।

বিক্রমেণ ত্রয়ো লোকাঃ পুরুষোহসি সনাতনঃ।।

(মহাভারত – ১২/৪৬/১১৯)

(অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)

অনুবাদ: হে নারায়ণ (শ্রীকৃষ্ণ)! গুরুর কৃপায় ও তত্ত্বজ্ঞান দ্বারা আমি এখন আপনার সেই চিরন্তন, সনাতন রূপকে প্রত্যক্ষ করতে পারছি।

আমি দেখতে পাচ্ছি—

আপনার শিরে স্বর্গলোক,

আপনার পদযুগলে অধিষ্ঠিত বসুন্ধরা (পৃথিবী),

আর আপনার বিক্রম ও মহিমা দ্বারা সম্পূর্ণ ত্রিভুবনই পরিব্যাপ্ত।

আপনিই সেই অনাদি-অনন্ত সনাতন পুরুষ, যিনি সর্বত্র বিরাজমান।

ব্যাখ্যা / তাৎপর্য: এই শ্লোকটি শ্রীকৃষ্ণের বিরাট রূপ বা "বিরাট পুরুষ সনাতন নারায়ণ" স্বরূপের এক অলৌকিক উপলব্ধি। এখানে কবি বলছেন—তিনি গুরুর উপদেশে, আত্মজ্ঞানের মাধ্যমে এখন উপলব্ধি করতে পারছেন যে, শ্রীকৃষ্ণ কেবল একজন মানবসদৃশ অবতার নন, তিনি সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ডকে ধারণ করা সেই চিরন্তন সর্বশক্তিমান পুরুষ।

শ্লোকে তাঁর রূপকে ত্রিভুবনব্যাপী হিসেবে দেখানো হয়েছে—স্বর্গ তার শিরে, পৃথিবী তার পদে, আর সমগ্র তিনটি লোক (স্বর্গ, মর্ত্য, পাতাল) তাঁর বিক্রমে পরিব্যাপ্ত। এটি গীতার ১১তম অধ্যায়ে অর্জুনের যে বিশ্বরূপ দর্শন হয়েছিল, সেই অনুরূপ ভাবনার প্রতিধ্বনি।সুতরাং, এই শ্লোক অকাট্যভাবে প্রকাশ করে—

👉 শ্রীকৃষ্ণই সেই চিরন্তন, সর্বব্যাপী "পুরুষোত্তম",

👉 যাঁর রূপ সীমাবদ্ধ নয় শরীরে, বরং সমগ্র বিশ্ব তাঁর রূপেরই প্রকাশ। 

৯| একোহপি কৃষ্ণস্য কৃতপ্রণামো দশাশ্বমেধাবভূথেন তুল্যঃ। দশাশ্বমেধী পুনরেতি জন্ম কৃষ্ণপ্রণামী ন পুনর্ভবায়।। (মহাভারত- ১২/৪৬/১২৩) (অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)  অনুবাদঃ কৃষ্ণের উদ্দেশ্যে একটি মাত্র প্রণাম করিলেও তাহা দশটি অশ্বমেধযজ্ঞের সমান হইয়া থাকে। দশটি অশ্বমেধযজ্ঞকারীর পুনরায় জন্মগ্রহণ করিতে হয়, কিন্তু কৃষ্ণকে প্রণামকারীর পুনরায় জন্ম (পুনর্জন্ম) হয় না।  

১০| নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ। জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।। (মহাভারত- ১২/৪৬/১২৬)  অনুবাদঃ ব্রাহ্মণদের আরাধ্যদেব অর্থাৎ নারায়ণ, গো ও ব্রাহ্মণদের হিতকারী এবং জগতের কল্যাণকারী সেই কৃষ্ণকে, গোবিন্দকে বার বার নমষ্কার করি।  

১১| বিশ্বকর্ম্মন্! নমস্তেহস্তু বিশ্বাত্মন্! বিশ্বসত্তম!। তথা ত্বামভিজানামি যথা চাহং ভবান্ মতঃ।। ত্বত্তেজঃসম্ভবো নিত্যং হুতাশো মধুসূদন। রতিঃ ক্রীড়াময়ী তুভ্যং মায়া তে রোদসী বিভো!।। (মহাভারত- ১৪/৬৭/৮-৯) (অনুবাদকঃ হরিদাস সিদ্ধান্তবাগীশ)  অনুবাদঃ হে বিশ্বকর্ম্মন! হে বিশ্বাত্মন! হে বিশ্বশ্রেষ্ঠ! তোমাকে নমষ্কার। আমি মনে মনে তোমাকে যেরূপ ধারণা করি, কার্যদ্বারাও তোমাকে সেইরূপই জানিতেছি। প্রভু মধুসূদন (শ্রীকৃষ্ণ)! অগ্নি সর্বদাই তোমার তেজ হইতে উৎপন্ন হন এবং রতি তোমারই ক্রীড়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত্ত্য তোমারই মায়া।  [[ তাৎপর্যঃ ]] এই শ্লোকটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ--- অনেকেই অশ্বমেধিকপর্বের একটি শ্লোক দেখিয়ে বলে যে--- এই যে দেখ শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে গীতা বলেছে। শ্রীকৃষ্ণ ঈশ্বর নয়।।  কিন্তু সেই মূর্খেরা উক্ত অশ্বমেধিকপর্বের শ্লোকটি চোখেই দেখেনি।


যদি তারা ওই শ্লোকটি দেখত, তাহলে নিশ্চিত বলা যেত না যে, শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে গীতার কথা বলেছেন। অশ্বমেধিক পর্বের ১৭ নম্বর অধ্যায়ের ১৩ নম্বর শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ স্পষ্ট বলছেন যে, তিনি যোগে থাকেন এবং গীতা বলেন। তাহলে অশ্বমেধিক পর্বের ৬৭ নম্বর অধ্যায়ের ৮-৯ নম্বরে অর্জুন কেন শ্রীকৃষ্ণকে হে বিশ্বকর্ম্মন, হে বিশ্বাত্মন, হে বিশ্বশ্রেষ্ঠ! বলে সম্বোধন করলেন? আপনারা নিজে বিচার করুন।

এটা শুধু নয়, অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে আরো বলেছেন—অগ্নি সর্বদা তোমার তেজ থেকে সৃষ্টি হয় এবং রতি তোমারই ক্রীড়াস্বরূপা, আর স্বর্গ ও মর্ত্য তোমারই মায়া। আসলে অশ্বমেধিক পর্বের ১৭ নম্বর অধ্যায়ের ১৩ নম্বরে শ্রীকৃষ্ণ যোগযুক্ত হয়ে গীতা বলেছেন বিষয়টি পরিষ্কার নয়। 

যদি সেখানে যোগযুক্ত বলতে পরমাত্মার সাথে সংযোগ বোঝানো হতো, তাহলে অশ্বমেধিক পর্বের ৬৭ নম্বর অধ্যায়ের ৮-৯ নম্বরে অর্জুন শ্রীকৃষ্ণকে এমনভাবে সম্বোধন করতেন না। যোগ শব্দটির অনেক অর্থ রয়েছে। এখানে যোগ শব্দটির অর্থ স্পষ্ট যে, একাগ্রতার সহিত। 

ভগবান শ্রীকৃষ্ণ যুদ্ধের আগে অর্জুনকে গীতা শুনিয়েছিলেন একাগ্রতার মাধ্যমেই। তাহলে আবার একই কথা বলার কী প্রয়োজন আছে? আর অর্জুন কি গীতা ভুলে গেছেন তার দুর্বলতার কারণে? তাঁকে আবার গীতা শোনালেও কি তিনি তা ভুলে যাবেন না, তার নিশ্চয়তা কী? তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বললেন, আমি তোমাকে পুরানো গল্প বলছি, যেন সেই গীতাজ্ঞান ইতিহাসের মাধ্যমে বুঝিয়ে দেওয়া যায়। কারণ গল্পের মাধ্যমে জটিল বিষয়গুলো আলোচনা করা সহজ হয়। এটা মনে রাখা আসলে বেশ সহজ। আরও অনেক প্রমাণ আছে মহাভারত-ে, যেখানে পরিষ্কার লেখা আছে যে শ্রীকৃষ্ণই বাসুদেব, শ্রীকৃষ্ণই জগৎপতি, বিশ্বেশ্বর, বিশ্বাত্মন, বিশ্বরূপ, আর তিনি পরম ব্রহ্ম এবং পরমেশ্বরও।

👉 ব্রহ্মসংহিতায় বলা হয়েছে----  

১| শ্লোক: ঈশ্বরঃ পরমঃ কৃষ্ণঃ সচ্চিদানন্দবিগ্রহঃ।

অনাদিরাদির্গোবিন্দঃ সর্বকারণকারণম্।।

(ব্রহ্মসংহিতা – ৫/১)

অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণই পরম ঈশ্বর—তিনি চিরশুদ্ধ, চেতন ও আনন্দময় রূপে বিরাজমান। তিনি অনন্তকালের পূর্বেও ছিলেন এবং তিনিই সকল সৃষ্টির মূল। 'গোবিন্দ' নামে তিনি পরিচিত, আর তিনিই সমস্ত কারণের কারণ।

২| শ্লোক: অদ্বৈতম্ অচ্যুতম্ অনাদিম্ অনন্তরূপম্

আদ্যং পুরাণপুরুষং নবযৌবনঞ্চ।

বেদেষু দুর্লভম্ অদুর্লভম্ আত্মভক্তৌ

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

(ব্রহ্মসংহিতা – ৫/৪২)

অনুবাদ:আমি সেই আদিপুরুষ গোবিন্দের ভজন করি, যিনি এক ও অদ্বিতীয়, অচ্যুত, অনাদি এবং অসংখ্য রূপে অভিন্ন। তিনি প্রাচীন হয়েও চিরনবীন যৌবনে দীপ্ত। তাঁকে বেদশাস্ত্রের দ্বারা লাভ করা কঠিন, কিন্তু আন্তরিক ভক্তির দ্বারা তাঁকে সহজেই লাভ করা যায়।


৩| শ্লোক:

রামাদিমূর্তিষু কলানিয়মেন তিষ্ঠন্

নানাবতারম্ অকরোদ্ ভূবনেষু কিন্তু।

কৃষ্ণঃ স্বয়ং সমভবৎ পরমঃ পুমান্ যঃ

গোবিন্দম্ আদিপুরুষং তমহং ভজামি।।

(ব্রহ্মসংহিতা – ৫/৪৮)

অনুবাদ: যিনি রামচন্দ্রসহ বহু অবতার রূপে কলার মাধ্যমে জগতে অবতীর্ণ হয়েছেন এবং নানাভাবে পৃথিবীর কল্যাণ সাধন করেছেন, তবে যিনি স্বয়ং পরম পুরুষরূপে শ্রীকৃষ্ণরূপে আবির্ভূত হয়েছেন—সেই আদিপুরুষ গোবিন্দকেই আমি ভক্তিভরে স্মরণ ও পূজা করি।

শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা
 শ্রীকৃষ্ণকে ঈশ্বর বলা


👉শ্রীচৈতন্য চরিতামৃতে বলা হয়েছে---- 

১| শ্লোক:

স্বয়ং ভগবান কৃষ্ণ, কৃষ্ণ সর্বাশ্রয়।

পরম ঈশ্বর কৃষ্ণ, সর্বশাস্ত্রে কয়।।

(চৈতন্য চরিতামৃত, আদি লীলা – ২/১০৬)

অনুবাদ: শ্রীকৃষ্ণই স্বয়ং ভগবান, তিনিই সমগ্র সৃষ্টির মূল ও সর্বাশ্রয়। সকল শাস্ত্রসমূহ ঐক্যবদ্ধভাবে তাঁকেই পরম ঈশ্বররূপে ঘোষণা করেছে।

২| শ্লোক:

কৃষ্ণ এক সর্বাশ্রয়, কৃষ্ণ সর্বধাম।

কৃষ্ণের শরীরে সর্ববিশ্বের বিশ্রাম।।

(চৈতন্য চরিতামৃত, আদি লীলা – ২/৯৪)

অনুবাদ:শ্রীকৃষ্ণই একমাত্র সর্বাশ্রয়, তিনিই সকল ধামের উৎস ও পরম গন্তব্য। তাঁর দিব্য শরীরেই সম্পূর্ণ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড অবস্থান করে ও বিশ্রাম নেয়।


উপসংহার:

বেদ, উপনিষদ, পুরাণ, মহাভারত এবং গীতা—সব শাস্ত্র একবাক্যে এই সত্যই ঘোষণা করেছে যে শ্রীকৃষ্ণই পরম পরমেশ্বর, সর্বোচ্চ সত্য।

Post a Comment

0 Comments