সত্যিকারের বন্ধু চেনার কিছু উপায় আছে, যা আপনাকে বুঝতে সাহায্য করবে কে আপনার প্রকৃত বন্ধু এবং কে শুধুই স্বার্থপর বন্ধুত্ব করছে। আসুন কিছু গুরুত্বপূর্ণ লক্ষণ দেখে নেই—
১. কঠিন সময়ে পাশে থাকা
দুঃখ-কষ্টেও পাশে থাকে সত্যিকারের বন্ধু, শুধু আনন্দের মুহূর্তেই নয়। যদি কেউ আপনার খারাপ সময়ে আপনাকে সান্ত্বনা দেয়, সাহায্য করতে চায়, তাহলে সে সত্যিকারের বন্ধু।
২. স্বার্থ ছাড়া সম্পর্ক
যদি কেউ শুধুমাত্র আপনার উপকারের জন্যই আপনার সঙ্গে মিশে, তাহলে সে প্রকৃত বন্ধু নয়। সত্যিকারের বন্ধু স্বার্থের ঊর্ধ্বে গিয়ে সম্পর্ক গড়ে তোলে।
৩. সৎ ও খোলামেলা কথা বলে
একজন ভালো বন্ধু আপনার ভুল শুধরানোর জন্য খোলামেলা ও সত্য কথা বলবে, এমনকি আপনি যদি তা পছন্দ না করেন তাও। কারণ তারা চান আপনি ভালো থাকুন।
![]() |
বন্ধু বা মিত্র |
৪. ঈর্ষা নয়, উৎসাহ দেয়
আপনাকে এগিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করে,আপনার সাফল্যে যে ব্যক্তি খুশি হয় সে প্রকৃত বন্ধু। কিন্তু যে আপনাকে নিচে নামাতে চায় বা ঈর্ষান্বিত হয়, সে প্রকৃত বন্ধু নয়।
৫. শ্রদ্ধা ও সমর্থন প্রদান করে
একজন সত্যিকারের বন্ধু আপনার মতামত, ইচ্ছা ও ব্যক্তিত্বকে সম্মান করে এবং আপনাকে সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে।
৬. নির্ভরযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা
যে বন্ধু আপনার গোপন কথা গোপন রাখতে পারে এবং আপনার প্রতি বিশ্বস্ত থাকে, সেই প্রকৃত বন্ধু। যারা পেছনে কথা বলে বা বিশ্বাস ভঙ্গ করে, তারা সত্যিকারের বন্ধু নয়।
৭. আপনাকে নিজের মতো থাকতে দেয়
যে বন্ধুর সামনে আপনি নিজের মতো স্বাভাবিকভাবে থাকতে পারেন, অভিনয় করতে হয় না, সেই সত্যিকারের বন্ধু।
এছাড়াও, সত্যিকারের বন্ধুত্ব ধৈর্য, সহমর্মিতা ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার উপর গড়ে ওঠে।
বন্ধু বা মিত্র কি?
প্রকৃত বন্ধু বা মিত্র ৩ প্রকার
যথা-১) বন্ধু। ২) সখা। ৩) সুহৃদ।
বন্ধুঃ বন্ধু হলো সেই লোক, যারে আপনি সহজে আপনার খুশি, দুঃখ, আশা, ভয় ও গোপন কথা ভাগ করে নিতে পারেন। একজন ভালো বন্ধু শুধু আনন্দের সঙ্গী নয়, কঠিন সময়ে পাশে থাকা একজন ভরসার ব্যক্তি। বন্ধুত্ব মানে বিশ্বাস, সহানুভূতি, আর নিঃস্বার্থ ভালোবাসা—যেখানে আপনি শুধু অন্যের জন্য ভালো চাওয়ার জন্য থাকেন। বন্ধু আপনাকে আপনার ভুলগুলো জানায়, সাফল্যে খুশি হয়, আর ব্যর্থতায় আপনাকে সাহস দেবে। পরিবারের মতো বন্ধুও জীবনটা ভালোভাবে কাটাতে সাহায্য করে। সত্যিকারের বন্ধুত্ব সত্যিই এক আশীর্বাদ, যা প্রতিদিনের জীবনকে আরও সুন্দর করে তোলে। তবে এর ব্যতিক্রমও দেখা যায় যেমন ,বন্ধু মানে এমন কেউ, যে কিছু দিন আপনার সাথে থাকে, তারপর চলে যায়। এরা বেশি আসে জীবনে। যেমন, স্কুল বা কলেজে যখন একটা সময় মজা করতে হয়, তখন পকেটেও কিছু টাকা থাকলে বন্ধুরা জমে যায়। কিন্তু পকেট খালি হলেই সবকিছু বদলে যায়। বসন্তের কোকিল যেমন গান গায়, কিন্তু গরমের সময় চলে যায়। কারণ, তাতে তার সুখ নেই। বন্ধুও এমনই ।
সখাঃ সখা শব্দটা আসলে সংস্কৃত থেকে এসেছে, যার মানে হল—অন্তরঙ্গ বন্ধু, আসলে হৃদয়ের খুব কাছের একজন। সখা এমন কেউ, যিনি শুধু সঙ্গী নন, बल्कि আত্মারও বন্ধু। সখার সঙ্গে সম্পর্ক থাকে নিখাদ ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং সত্যিকারের স্নেহের। আপনার সুখে উচ্ছ¡ল হয়, দুঃখে পাশে থাকে, আর জীবনের প্রতিটি ধাপে সঙ্গ দেয়। প্রাচীন ধর্মীয় এবং সাহিত্যিক বইগুলোতেও কৃষ্ণ ও সুধামার, কৃষ্ণ ও অর্জুনের বন্ধুত্বে সখা শব্দটার গভীরতা আসে—এটা শুধু সামাজিক সম্পর্ক নয়, বরং আধ্যাত্মিক সম্পর্কেরও প্রতীক। সখা হল সেইজন, যাঁর কাছে আপনি স্বাচ্ছন্দ্যে নিজের মনের কথাগুলো বলতে পারেন, যিনি আপনার অনুভূতিগুলো বুঝতে পারেন এবং যিনি আপনার জীবনের বিশ্বাসযোগ্য সঙ্গী। সখা তোমায় অন্ধের মতো ভালোবাসে। তুমি যেটা করো, সেটাই ঠিক। অন্যরা কিছু বলুক, তুমি জানো তুমি ঠিক আছো। সে ঠিক হোক বা ভুল, সব সময় তোমার পাশে থাকবে। তুমি ভাবতে পারো যে কিছু ভুল হচ্ছে, কিন্তু সে তোমায় বলবে, 'নাহ, তুমি ঠিক করেছো।' কারণ সে তোমায় খুব ভালোবাসে, তাই খারাপ বা ভালো, সব সময় তোমার পাশে থাকবে। ঠিক যেমন কর্ণ আর দুর্যোধনের ব্যাপার ছিল।
সুহৃদঃ “সুহৃদ” শব্দটা দুইটি অংশ থেকে এসেছে—“সু” মানে ভালো আর “হৃদ” হল মন। অর্থাৎ, সুহৃদ হল সেই মানুষ, যার মন ভালো কাজ, মঙ্গল কামনা আর শুভবোধে ভরা। তিনি এমন একজন, যিনি আপনার ভালোর জন্য নিঃস্বার্থভাবে চিন্তা করেন, আপনার কষ্টে নিজেকে অনুভব করেন আর কেবলমাত্র ভালবাসা থেকেই পাশে থাকেন। সুহৃদতা বন্ধুত্বের একটা গভীর রূপ—এটা শুধু কথায় নয়, বরং কাজ, অনুভূতি আর নীরব সহানুভূতিতে প্রকাশ পায়। একজন সুহৃদ আপনার জীবনে আলো জ্বালাতে আসেন, কখনও পরামর্শ দিয়ে, কখনও শুধু চুপচাপ পাশে থেকে। আধ্যাত্মিক গ্রন্থে বলা হয়েছে, “সুহৃদং সর্বভূতানাং” মানে “সকল জীবের পরম সুহৃদ হলেন ভগবান”—মানে একজন সত্যিকারের সুহৃদ শুধু একজন ব্যক্তি নয়, বরং এক ধরনের আশ্রয়ও। সুহৃদ মানে এমন একজন, যে সত্যিই আপনার ভাল চান। যখন আপনি ভুল করবেন, তিনি আপনাকে বলবেন, 'এটা ঠিক নয়।' হয়তো আপনার খারাপ লাগবে, কিন্তু সে সঠিক কথা বলবে। আর যখন আপনি ভালো কিছু করবেন, তখন তিনি আপনাকে উৎসাহ দেবেন। সুহৃদ সবসময় আপনার পাশে থেকে সঠিক পথে নিয়ে চলতে সাহায্য করবেন। তাই আপনাকে ভাবতে হবে, আপনি কেমন মানুষ এবং কাদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবেন।
সত্যিকারের বন্ধু সেই যে জন্মের পর জন্ম আমাদের সাথে থাকে। কিন্তু অনেকসময় আমরা তাকে চিনি না। শ্রীকৃষ্ণ গীতায় এ নিয়েই কথা বলেছেন,
ভোক্তারং যজ্ঞতপসাং সর্বলোকমহেশ্বরম্।
সুহৃদং সর্বভূতানাং জ্ঞাত্বা মাং শান্তিমৃচ্ছতি।।
(গীতা-৫/২৯)
অনুবাদ : আমাকে তপস্যার পরম ভোক্তা ও সমস্ত যজ্ঞ , সমস্ত জীবের সুহৃদরূপে এবং সর্বলোকের মহেশ্বর জেনে শান্তি লাভ করেন যোগীরা জড় জগতের দুঃখ-দুর্দশা থেকে মুক্ত হয়ে।
এই জড় জগতের দুর্দশা ও দুঃখ থেকে তখনই মুক্তি পাব আমরা এবং পরম শান্তি লাভ করতে পারব যখন পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে সমস্ত জীবের সুহৃদ রূপে জানতে পারবো এবং সকল কিছুর ভোক্তা হিসেবে ।
“সখা”, “সুহৃদ” এবং “বন্ধু”—এই তিনটির তুলনামূলক ব্যাখ্যা
গল্প:
তিন বন্ধুর ইতিহাস
এক গ্রামে তিনজন বন্ধু ছিল—রাহুল, অর্ণব
আর সুদীপ্ত। তারা একসঙ্গে স্কুলে
যেত, খেলাধুলা করত, আর সন্ধ্যায়
বটগাছের নিচে বসে গল্প
করত মজা করে। একদিন
রাহুল শহরে পড়তে চলে
গেল, আর অর্ণব গ্রামে
ব্যবসা শুরু করল। সুদীপ্ত,
একটু চুপচাপ ছেলে, গ্রামে থেকে গরীবদের সাহায্য
করতে লাগল। এক বছর পর
রাহুল গ্রামে ফিরে আসে। তার
জীবনে কিছু সমস্যা ছিল—শহরে ব্যবসা উদ্বিগ্ন
হয়ে পড়েছে, আর কেউ সাহায্য
করতে চায়নি। প্রথমে সে অর্ণবের কাছে
গেল। অর্ণব তার খোঁজখবর নিল,
খেতে দিল, থাকার জায়গা
দিল। কিন্তু কিছুদিন পর বলল, “আমি
সব কিছুর দায়িত্ব নিতে পারি না!”
তারপর রাহুল সুদীপের কাছে গেল। যদিও
সুদীপ্তের ঘর ভাঙা ছিল,
সে রাহুলকে আশ্বাস দিয়ে বলল, “তুই
টাকা হারিয়েছিস, কিন্তু মনোবল হারানো ঠিক নয়। তোর
আবার উঠে দাঁড়ানো দরকার।”
সুদীপ্ত তার পাশে বসিয়ে
নিজের বই দিল এবং
কিছু টাকা দিয়ে কাজে
লাগাতে বলল। সে কখনো
বড়লোক ছিল না, কিন্তু
রাহুলের মনে জায়গা করে
নিল। এখন রাহুল জানে—অর্ণব ছিল তার বন্ধু,
সুদীপ্ত তার সাচ্চা সুহৃদ,
আর শহরে সেই একজন—প্রতিদিন ফোন করে তার
সুখ-দুঃখ ভাগ করে
নিত, তাকে খুব কাছের
মনে করত—সে ছিল
তার সখা।
গল্পের
শেষ কথা:
বন্ধুরা
পাশে থাকে, সখা মনে বোঝে,
আর সুহৃদ চুপচাপ ভালো চায়—এরা
তিনজনই গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু তাদের ভূমিকা আলাদা।
পরিশেষে একটি কথাই বলতে চাই বন্ধু,সখা আর সুহৃদ যাই হোক না কেন, সম্পর্ক গুলো টিকে থাকবে আপনি ও আপনার সঙ্গী এই দুই জনের উপর নির্ভর করবে আপনার সম্পর্ক কতদূর গড়বে বা কতদিন টিকে থাকবে।
0 Comments