সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভগবান হলেন সেই সত্তা যিনি সমস্ত গুণ, জ্ঞান এবং শক্তিতে সম্পূর্ণ, যিনি সমগ্র বিশ্বের সৃষ্টি, রক্ষা ও প্রলয়ের কারণ, এবং যিনি সকল প্রাণীর আসল আশ্রয়।
ভগবান কাকে বলে?
“ভগবান” শব্দটির ব্যুৎপত্তিগত অর্থ এবং শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যার ভিত্তিতে_ভগবান শব্দটার মানে হল সেই সত্তা, যিনি নিচের ছয়ে গুণে পরিপূর্ণ। এই ছয়টি গুণকে একসঙ্গে বলা হয় “ভগ” আর যিনি এসব গুণের অধিকারী, তিনিই হলেন ভগবান:
১. ঐশ্বর্য – সমস্ত দানের মালিক
২. বীর্য – অসীম শক্তি ও ক্ষমতা
৩. যশ – সর্বত্র পরিচিতি
৪. শ্রী – অনন্য সৌন্দর্য ও দীপ্তি
৫. জ্ঞান – সর্বজ্ঞাতা
৬. বৈরাগ্য – সব কিছুর থেকে দূরে থাকলেও সবকিছুর ওপর অধিকার
এই ব্যাখ্যাটা “বিশ্ণু পুরাণ”-এ পরাশর মুনি দিয়ে গেছেন।
ঈশ্বর শব্দের বিভিন্ন প্রতিশব্দ রয়েছে, যা প্রেক্ষাপট এবং ধর্মীয় বা দার্শনিক দৃষ্টিকোণ অনুসারে প্রযোজ্য। ভগবান শব্দের বেশ কয়েকটি প্রতিশব্দ রয়েছে। যেমন: ঈশ্বর, পরমেশ্বর, মহাদেব, সর্বশক্তিমান, জগদীশ্বর, সৃষ্টিকর্তা, নারায়ণ, শ্রীহরি, বিধাতা, প্রভু ইত্যাদি।
![]() |
ভগবান শব্দের প্রতিশব্দ |
এই শব্দগুলো বিভিন্ন প্রসঙ্গে আলাদা আলাদা অর্থ পেতে পারে। এখানে কিছু পরিচিত সমার্থক শব্দ বলা হলো: দেবতা, সর্বশক্তিমানের ধারণা, স্রষ্টা।
হিন্দু ধর্মে: ব্রহ্ম (আসল বাস্তবতা), ঈশ্বর, ভগবান, পরমাত্মা।
বাইবেলে এবং খ্রিস্টধর্মে: প্রভু, যিহোবা, ইয়াহওয়ে, এলোহিম, আদোনাই, পিতা।
ইসলাম ধর্মে: আল্লাহ, আর-রহমান (সর্বাধিক করুণাময়), আর-রহিম (সর্বাধিক করুণাময়)।
গ্রীক ও রোমান পুরাণে: জিউস (গ্রীক), বৃহস্পতি (রোমান)।
দার্শনিক ও রূপকভাবে: মহাবিশ্ব, পরম, অসীম, উৎস।
হিন্দু ধর্ম অনুসারে ব্যাখ্যাঃ পরাশর মুনি ভগবান শব্দের মানে বোঝান। 'ভগ' মানে ঐশ্বর্য আর 'বান' মানে যার রয়েছে। অনেক রকমের রূপ থাকলে তাকে আমরা রূপবান বলি, আর যার প্রচুর সম্পদ আছে, তাকে ধনবান বলি। ঠিক তেমনিই যিনি ঐশ্বর্যের মালিক, তাকে ভগবান বলা হয়। সহজ বললে, যার মধ্যে পাঁচটা বিশেষ গুণ আছে, তিনিই ভগবান।
ব্যাসদেবের পিতা পরাশর মুনি ভগবান শব্দটি সংস্কৃত এবং এর অর্থ বিশ্লেষণ করেছেন_
ঐশ্বর্যস্য সমগ্রস্য, বীর্যস্য, যশসঃ, শ্রিয়ঃ, জ্ঞান-বৈরাগ্যয়োশ্চ—এই ছয়টি গুণ যার মধ্যে পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান, তিনিই ‘ভগবান’। তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বঐশ্বর্যময়। সমস্ত ধন, শক্তি, যশ, সৌন্দর্য, জ্ঞান ও বৈরাগ্য তাঁর মধ্যেই বিরাজমান। এ জগতে কেউ হয়তো ধনী হতে পারে, কেউ হতে পারে জ্ঞানী বা শক্তিশালী, কিন্তু কেউই দাবি করতে পারে না যে তার মধ্যে এই ছয়টি গুণ পূর্ণমাত্রায় বিদ্যমান। অপরদিকে, ভগবানই সেই মহাশক্তি, যাঁর মধ্যে এই সমস্ত গুণ সর্বাঙ্গীনভাবে রয়েছে—এই কারণেই তাঁকেই বলা হয় ‘ভগবান’।
বেদান্ত সূত্রের প্রথম শ্লোকে বলা হয়েছে—‘অথাতো ব্রহ্ম জিজ্ঞাসা’—অর্থাৎ এখন আমরা সেই পরম ব্রহ্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করব। পরবর্তী শ্লোকে এর উত্তরে বলা হয়েছে—‘জন্মাদ্যস্য যतः’, যার অর্থ: ‘যাঁর থেকে এই সমস্ত জগতের সৃষ্টি, রক্ষণ এবং লয় হয়—তিনিই পরম ব্রহ্ম।’ সেই ব্রহ্মই ভগবান।
এই সূত্রটিই মহর্ষি ব্যাসদেব শ্রীমদ্ভাগবতের প্রথম শ্লোকে প্রকাশ করেছেন—
‘জন্মাদ্যস্য যতোঃ অন্বয়াদ্ ইতরতঃ চ অর্থেষু অভিজ্ঞঃ স্বরাট্।’
এর অর্থ—'যাঁর থেকে এই অনন্ত কোটি ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি, স্থিতি ও প্রলয় ঘটে, সেই পরম ব্রহ্মই ভগবান। তিনি সব কিছু জানেন, স্বয়ং প্রভু এবং পরিপূর্ণ জ্ঞান ও শক্তির অধিকারী।'
এ প্রসঙ্গে ভগবদ্গীতার একটি গুরুত্বপূর্ণ শ্লোক উল্লেখযোগ্য:
“অহং সর্বস্য প্রভবঃ, মত্তঃ সর্বং প্রবর্ততে।”
অর্থাৎ—‘আমি সর্বকিছুর উৎস; সব কিছুই আমার থেকেই উদ্ভূত।’
এরপর বলা হয়েছে—
“ইতি মত্বা ভজন্তে মাং বুধা ভাবসমন্বিতাঃ।”
অর্থাৎ—‘এইভাবে যাঁরা আমাকে সব কিছুর মূল ও পরম সত্য বলে উপলব্ধি করেন, জ্ঞানীরা হৃদয়ের গভীর ভক্তিসহকারে আমাকে আরাধনা করেন।’এভাবে দেখা যায়, ভগবানই এই জগতের উৎস, স্থিতি ও লয়ের অধিষ্ঠাতা এবং তিনিই সর্বজ্ঞ, সর্বশক্তিমান পরম ব্রহ্ম।
ভগবদগীতাতে
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বলেছেন, সব কিছুর উৎস
তিনি। অর্থাৎ, সবকিছুর স্রষ্টা, তাকে পালন করেন
এবং আবার নিধন করেনও।
শাস্ত্রে ভগবানকে সর্বশক্তিমান বলা হয়েছে। তাকে
কেউ কেউ ঈশ্বর বলেও
ডাকে। তাই ঈশ্বরের অর্থটা
জানা দরকার। শাস্ত্র বা অভিধান অনুযায়ী,
ঈশ্বর মানে যারা নিয়ন্ত্রণ
করেন। এই জগতে প্রত্যেকটি
জীবের সীমিত নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা আছে, তাই তারা
নিজেদের বা দেবতাদের ঈশ্বর
মনে করতে পারে। কারণ
তারা বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কিছু কাজ নিয়ন্ত্রণ
করেন। সেই সর্বশক্তিমানকে জানতে
পারা হলো জীবনের উদ্দেশ্য,
যিনি ঈশ্বরকে নিয়ন্ত্রণ করেন। পরমেশ্বর বা পরম ঈশ্বর,
তিনিই ভগবান। সমাজে ভগবান শব্দটি যেভাবে খুশি ব্যবহার হচ্ছে,
সেটা সঠিক নয়। এই
শব্দটি ব্যবহার করা উচিত সতর্কতার
সঙ্গে, কারণ এটি শাস্ত্রবিরোধী
হয়ে উঠতে পারে।
শাস্ত্রমতে ভগবান এর সংজ্ঞা
শ্রীমদ্ভাগবত আর বিষ্ণু পুরাণে বলা হয়েছে, ভগবান হলেন সেই সত্তা যাঁর ছয়টি গুন পুরোপুরি রয়েছে।
(১) ঐশ্বর্য (ऐश्वर्य) – অসীম ক্ষমতা ও প্রভাব
(২) বীর্য (वीर्य) – অসীম শক্তি ও পরাক্রম
(৩) যশ (यश) – সর্বত্র প্রসারিত খ্যাতি
(৪) শ্রী (श्री) – অনন্ত সৌন্দর্য ও সম্পদ
(৫) জ্ঞান (ज्ञान) – সর্বজ্ঞতা ও পরম জ্ঞান
(৬) বৈরাগ্য (वैराग्य) – সকল প্রকার আসক্তি থেকে মুক্তি
গীতায় ভগবান
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে "ভগবান" বলে ঘোষণা করেছেন:
"শ্রীভগবান উবাচ" – (ভগবদ্গীতা ২.২)
এখানে কৃষ্ণকে "ভগবান" বলা হয়েছে, অর্থাৎ যিনি ঐশ্বর্য, জ্ঞান, শক্তি, সৌন্দর্য, বৈরাগ্য ও যশে পূর্ণ।
ভগবান ও দেবতা মধ্যে পার্থক্য
ভগবান: সর্বোচ্চ পরম সত্তা, যিনি সব কিছুর মূল কারণ (যেমন, শ্রীকৃষ্ণ, নারায়ণ, শিব, দুর্গা ইত্যাদি)।
দেবতা: ভগবানের অধীনস্থ শক্তিধর সত্তারা, যাঁরা বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন (যেমন, ইন্দ্র, বরুণ, অগ্নি, চন্দ্র ইত্যাদি)।
“ভগবান” শব্দের ব্যাখ্যা
সংস্কৃত ভাষায় “ভগবান” শব্দটি মূলত দুইটি অংশে বিভক্ত:
“ভগ” (भग) অর্থ ঐশ্বর্য, গুণ, সম্পদ, জ্ঞান, শক্তি, সৌভাগ্য ইত্যাদি।
“বান” (वान) অর্থ যার মধ্যে বিদ্যমান বা যিনি ধারণ করেন।
ভগবান সম্পর্কে আধ্যাত্মিক ব্যাখ্যা:
ভগবান
হলেন সবকিছুর উৎস।
তিনি কোন একটি ধর্ম
বা দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ নন; তিনি সব
জায়গায়, সব সময় এবং
সবকিছুর মাঝে আছেন। আধ্যাত্মিক
দৃষ্টিতে, তিনি শুধু একজন
শক্তিশाली দেবতা নন, বরং তিনি
সেই এক সত্তা, যিনি
এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টির আধার, রক্ষক এবং ধ্বংসক। উপনিষদ
ও বেদান্তে তাঁকে বলা হয় পরম
ব্রহ্ম, যিনি স্বরূপে নেই,
কিন্তু ভক্তি দিয়ে তাঁকে যে
কোনও রূপে পাওয়া যায়।
তিনি অসীম জ্ঞান, শক্তি,
সৌন্দর্য, শান্তি এবং নিখুঁত ভালোবাসার
প্রতীক। ভগবানের সাথে আত্মার সম্পর্ক
চিরন্তন। এখানে ভক্ত নিজেকে তাঁর
অংশ হিসেবে অনুভব করে এবং জীবনের
লক্ষ্য হয়ে ওঠে তাঁর
কাছাকাছি যাওয়া। সত্যিকারের আধ্যাত্মিকতা শুরু হয় যখন
মানুষ নিজের অহংকার ছাড়ে, ভগবানের প্রতি নিজেকে সমর্পণ করে এবং তাঁর
সৃষ্টির প্রতিটি জীবের মধ্যে ভগবানের উপস্থিতি অনুভব করতে শেখে।
উপসংহার: ভগবান বলতে সেই সব ক্ষমতাধর সত্তাকে বোঝায়, যিনি পুরো সৃষ্টির একমাত্র সৃষ্টি। তিনি সবকিছু জানেন এবং খুব দয়ালু। শাস্ত্র অনুসারে, ভগবান হলেন সেই অনন্ত অস্তিত্ব, যিনি চিরকাল ধরে আছেন এবং যাঁর মধ্যে সব ধরনের গুণ, শক্তি ও সৌন্দর্য পুরোপুরি রয়েছে।
0 Comments