হিন্দু বিবাহ রীতি: সম্পূর্ণ ধাপে ধাপে গাইড (বাংলায়)

হিন্দুধর্মের মধ্যে বিয়ে সামাজিক নিয়মের পাশাপাশি ধর্মীয় নিয়মকেও গুরুত্ব দেওয়া হয়। আজ আমি কিছু নিয়মের কথা বলছি আমাদের বিয়ের মাধ্যমে। যদিও এ সব নিয়ম অনেকেরই জানা আছে। হিন্দু ধর্মে বিবাহ একটা পবিত্র অনুষ্ঠান। এটা শুধু সামাজিক বা আইনগত ব্যাপার না, ধর্মীয় দিক থেকেও এর গুরুত্ব অনেক। যদিও বিবাহের নিয়ম-কানুন কিছুটা ভিন্ন হতে পারে এলাকায় বা সম্প্রদায়ে, মূল বিষয়গুলো প্রায় একই থাকে।

হিন্দু বিবাহ রীতি
হিন্দু বিবাহ রীতি


অষ্টবিধ বিবাহ – হিন্দু ধর্মে ৮ ধরনের বিবাহরীতি

হিন্দু ধর্মে মোট ৮  ধরনের বিয়ের রীতি আছে। এগুলো হল: ব্রাহ্ম, দৈব, আর্জ, প্রাজাপাত্য, আসুর, গান্ধর্ব, রাক্ষস , পৈশাচ এগুলোর কথা মনুসংহিতায় বলা হয়েছে, কিন্তু বেশিরভাগই এখন আর প্রচলিত নয়। আজকালকার বাঙালি হিন্দু সমাজে প্রাজাপাত্য বিয়ে দেখা যায়। দেবতা প্রজাপতিকে বিয়ের দেবতা হিসাবে মানা হয়, তাই এই বিয়ের নামেরও তার নাম অনুসারে রাখা হয়েছে। এই পদ্ধতিতে বর তার পরিচিত লোকদের নিয়ে কনের বাড়িতে যায় এবং সেখানে বিয়ে করে, পরে কনেকে নিজের বাড়িতে নিয়ে আসেন।

1. ব্রাহ্ম বিবাহ: হিন্দু ধর্মের মতে, ব্রাহ্ম বিবাহ হল সবচেয়ে পবিত্র বিবাহের ধরন। এখানে কন্যার বাবা একজন ধর্মভীরু, ভাল মানুষ এবং শিক্ষিত ব্রাহ্মণকে কন্যা দেন কোন যৌতুক বা শর্ত ছাড়াই। সময় ধর্মীয় নিয়ম অনুষ্ঠানের সঠিক পালন করা হয়। আজকাল অনেক দাম্পত্য জীবন ধরণের ব্রাহ্ম বিবাহের আদলে গড়ে উঠছে।

2. দৈব বিবাহ: এই প্রক্রিয়ায় কন্যাকে যজ্ঞ বা পূজার সময় ব্রাহ্মণ পুরোহিতের কাছে দান করা হয়। এটি ধর্মীয় অনুষ্ঠানে সাহায্য করার উদ্দেশ্যে ঘটে।

3. আর্জ বিবাহ: এখানে কন্যার বাবা পাত্রকে গরু বা অন্য একটি সামান্য উপহার দেয়ার পর কন্যাকে দেন। প্রাচীন হিন্দুশাস্ত্রে এটাকে বৈধ বিবাহের হিসেবেই দেখা হত, তবে এটা যৌতুকের এক পুরনো রূপ বলে বিবেচনা করা হয়। এখানে দেওয়া গবাদি পশু বা উপহার কখনোই পণ নয়, বরং ধর্মীয় আচারের অংশ। বর্তমানে এই প্রথা প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে।

4. প্রাজাপত্য বিবাহ: এই বিবাহ ব্রাহ্ম বিবাহের অনুরূপ, শুধু এখানে বরকে কন্যার পরিবারকে ভরণপোষণ ধর্মীয় দায়িত্ব নিতে হয়।

5. আসুর বিবাহ: এখানে পাত্র কন্যার বাবাকে কিছু অর্থ বা সম্পদের বিনিময়ে কন্যাকে 'ক্রয়' করে নেয়। হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে এটা নিন্দনীয় বিবাহ বলা হয়েছে, যেখানে কন্যাকে পণ্য হিসেবে দেখানো হয়। মনুস্মৃতিতে এটিকে অগ্রহণযোগ্য বলা হয়েছে কারণ এটি নারীর সম্মানের বিরুদ্ধে। এখন ধরনের বিবাহ আইনগতভাবে নিষিদ্ধ এবং সামাজিকভাবে অগ্রহণযোগ্য।

6. গান্ধর্ব বিবাহ: এখানে বর কনে একে অপরকে তাদের ইচ্ছায় বাছাই করে, কোন আনুষ্ঠানিকতা বা পরিবারের বাধা ছাড়াই। প্রাচীন হিন্দু শাস্ত্রে গান্ধর্ব বিবাহের উল্লেখ আছে, তবে এটি সামাজিক নিয়ম থেকে একটু আলাদা। আজকের প্রেমের বিয়ে বা কোর্ট ম্যারেজ আসলে এই গান্ধর্ব বিবাহের আধুনিক রূপ।

7. রাক্ষস বিবাহ: এই বিবাহে কন্যাকে জোর করে তুলে বিয়ে করা হত। প্রাচীনকালে বিজয়ী পক্ষ পরাজিত পক্ষের নারীদের এভাবে বিয়ে করত। এটি ছিল অমানবিক এবং অসম্মানজনক।

8. পৈশাচ বিবাহ: এটি হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে বর্ণিত অষ্টবিবাহের মধ্যে সবচেয়ে নিকৃষ্ট। এখানে কন্যাকে অজ্ঞান বা জোরপূর্বক ধর্ষণ করে পরে বিবাহের মাধ্যমে বৈধতা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। সব ধর্মগ্রন্থ এটিকে ঘৃণ্য অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

বিয়েতে ব্রাহ্মণের উপস্থিতি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিয়ের মন্ত্র পড়ানোর কাজটা একজন ব্রাহ্মণই করে। আমাদের বিয়ে তিনটি ভাগে হয়। প্রথমে বর আর বরযাত্রীদের আসা তাদের অভিবাদন। পরে বর বরযাত্রীদের আসন গ্রহণ এবং মূল বিয়ের অনুষ্ঠান। শেষে হচ্ছে বাসী বিয়ে।

পঞ্জিকার হিসাব অনুযায়ী বিয়ের তারিখ ও সময় ঠিক করা হয়। ভাদ্র ও চৈত্র মাসে হিন্দুরা বিয়ে করে না। এছাড়া, জন্ম বা মৃত্যু অশৌচ হলে বিয়ে করা নিষেধ। উদাহরণস্বরূপ, যদি পরিবারে কোনও শিশুর জন্ম হয়, তাহলে ১ মাসের মধ্যে কেউ বিয়ে করতে পারবে না। আর যদি কারও মৃত্যু হয়, তাহলে ১ বছরের মধ্যে বিয়ে করা যাবে না।

হিন্দু বিয়েতে একটা গুরুত্বপূর্ণ শর্ত হলো বর এবং কনের মধ্যে কোনও রক্তের যোগাযোগ থাকা চলবে না। অর্থাৎ, নিজের বা মায়ের পরিবার থেকে বিয়ে করা যাবে না। এছাড়াও, বাবার এবং মায়ের মামার পরিবারের সঙ্গে বিয়েও করা নিষেধ। এই সম্পর্কের লোকজন সাধারণত হিন্দু পরিবারে আপন ভাইবোনের মতো আচরণ করেন।

হিন্দু ধর্মে একাধিক বিয়ে করা যায় না!

বৈদিক মন্ত্রের সঙ্গে বিয়ে সম্পন্ন হয়, তাই এই সম্পর্ককে অমোচনীয় বলা হয়। হিন্দু ধর্মে বিবাহ বিচ্ছেদের সুযোগ নেই এবং নারীদের দ্বিতীয় বিয়ে করা একদম নিষিদ্ধ। পুরুষরা বিপত্নীক হলে দ্বিতীয় বিয়ে করতে পারে, কিন্তু নারীদের জন্য বিধবা হয়ে দ্বিতীয়বার বিয়ে করা কঠিন। আসলে, বিধবা কাউকে বিয়ে করা পুরুষদের জন্যও সহজ নয়।

বিয়ের বেশিরভাগ নিয়ম ঠিক থাকলেও বিধবা বিবাহ নিষিদ্ধ হয়ে থাকার কারণে হিন্দু সমাজে এটাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহের প্রচলন করেন এবং তার পুত্র নারায়ণ চন্দ্রকে একটি বিধবা মেয়ের সঙ্গে বিয়ে দেন।

এখানে হিন্দু বিবাহের কিছু মূল নিয়ম দেখা যাক

. পাত্র-পাত্রীর নির্বাচন: প্রথমেই কুল, গোত্র জাতি দেখে পাত্র বা পাত্রীর নির্বাচন করা হয়। মাঝে মাঝে কুণ্ডলী মিলানোও হয়।

 . কন্যাদান: পিতার কাজ হলো কন্যাকে ভালো পাত্রের কাছে দান করা। এটাকেকন্যাদানবলে, যা বিবাহের খুবই গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

. বিবাহের আগে অনুষ্ঠান: দর্শন আশীর্বাদ, হলুদের অনুষ্ঠান, বরযাত্রা।

. মূল বিবাহ অনুষ্ঠান: এখানে কিছু নিয়ম পালন করা হয়:- বর কনের মালাবদল (জয়মালা)- কন্যাদান

- আগুনের ঢাকে বিয়ে করা (বেদমন্ত্র পাঠ) - সাতটি পদক্ষেপ, যেখানে বর কনে আগুনকে কেন্দ্র করে সাতবার পদক্ষেপ করেন এবং প্রতিটি পদক্ষেপের সঙ্গে একটি প্রতিজ্ঞা হয়।- সিঁদুরদান মঙ্গলসূত্র পরানো।

. বিবাহোত্তর অনুষ্ঠান

বৌভাত গৃহপ্রবেশের মাধ্যমে নতুন জীবনের শুরু এবং সামাজিক স্বীকৃতি।

ধর্মের সাথে বিবাহের সম্পর্ক কি?

বিবাহ করেও মানুষের ধর্ম হয় কিন্তু আসল ধর্ম হলো ভগবানের দেওয়া নিয়ম-কানুন। অনেকেই ওই নিয়ম মানছে না। বিবাহ সংস্কারের ব্যাপারে জানা নেই অনেকের। মানুষ যখন ইন্দ্রিয়র বশীভূত হয়ে চলে, তখন পরিবারের এবং সমাজের অবস্থা খারাপ হয়।

হিন্দু ধর্মালম্বীদের বিবাহের ছবি
বিবাহের ছবি 

আত্মহত্যা, ভ্রূণহত্যা, শিশু হত্যার মতো লজ্জাজনক ঘটনা প্রতিদিন ঘটছে। এসব দেখে বোঝা যায় যে, বিবাহিত জীবনের আনন্দ অনেকের জন্য বিষণ্ণতায় পরিণত হয়েছে। প্রথমে তারা ভেবেছিল, তা সারকথা ‘শুভ পরিণয়’। বিবাহের আক্ষরিক অর্থ হচ্ছে বিশেষভাবে দায়িত্ব গ্রহণ করা। বিবাহিত জীবনকে যেন নারকীয় না বানায়, সেটা মাথায় রাখতে হয়। এমনকি অনেকেই বিয়ে না করেই অন্যের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। শ্রীল প্রভুপাদ বলেছিলেন, শান্তিপূর্ণভাবে জীবনযাপন করতে। কিন্তু কিছু মানুষ বিবাহিত হয়ে তাদের আচরণ আরও খারাপ করে। যারা ভগবদ্ভক্তি চর্চা করে না, তাদের জীবনে সব কিছুই বিশৃঙ্খল হয়ে যায়। শাস্ত্রে বলা হয়েছে, বিবাহ যজ্ঞের মতো। বর-বধূ যদি ভক্ত মন-মানসিকতার না হয়, তাহলে তারা কখনও ভগবানের সন্তুষ্টি লাভ করবে না। ভক্ত ছাড়া বিবাহ একেবারেই শুভ নন। শ্রীমদ্ভাগবতে বলা আছে, যে ব্যক্তি তার স্ত্রীর মুক্তির জন্য কিছু করতে পারবে না, তাঁকে বিবাহের জন্য যোগ্য বলা হয় না। সন্তানের জন্ম দেওয়া এবং তাদের সঠিক শিক্ষা দেওয়া খুব গুরুত্বপূর্ণ। যদি মা-বাবা সন্তানের জন্য সঠিক পথ না দেখান, তবে তারা বাবা-মা হওয়ার জন্য উপযুক্ত নন। এ ধরনের শিক্ষা শ্রী ঋষভ তাদের সন্তানদের দিয়েছেন। যদি মানুষ এগুলো জানে না, তাহলে তাদের জীবন সঠিক পথে নয়। অতএব, মানুষকে ভক্তিময় জীবন গ্রহণ করতে হবে। বিবাহ করা বা না করা তাতে কিছু যায় আসে না। গৃহে থাকো, বনে থাকো, সদা 'হরি' বলে ডাকো। হরিভজন ছাড়া সব কিছুই অধর্ম। হরিভজনের সঙ্গে সব কিছু ভাল, কিন্তু হরিভজনের বিরুদ্ধে যেটা, তা কখনও ভালো ফল দেয় না।

আপনারা সনাতন হিন্দু হিসেবে অনুরোধ করছি, দয়া করে আপনার সন্তানদের সঠিক ধর্ম অনুযায়ী বিয়ে দিন। এতে তাদের বৈবাহিক জীবন সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠবে।

Post a Comment

0 Comments