শ্মশান বলতে বোঝানো হয় সেই স্থান যেখানে সাধারণত মৃতদের শেষকৃত্য করা হয়। এটা মৃতদের স্থানও বলা হয়। শ্মশান হলো করালবদনী মা কালী বা আদ্যাশক্তির বিচরণক্ষেত্র। মা কালীকে অনেকেই ধ্বংসের দেবী মনে করেন, কিন্তু এখানে ধ্বংস কথাটা কোনো ধরনের ধ্বংস মানে নয়।
![]() |
শ্মশানে শবদাহ করার কারণ |
এটা আসলে সংহরণ বোঝায়, অর্থাৎ মা এই জগতটা তৈরি করেছেন এবং আবার তিনিই সবকিছু গুটিয়ে নেন। যেমন মাকড়শা নিজের তৈরি জালও কিভাবে আবার তুলে নেয় জীবনের কষ্ট সহ্য করে মানুষ যখন মায়ের আশ্রয়ে আসে, তখন তারা শান্তি ও সুখ পায়। তাই শ্মশান মা কালীর খেলার জায়গা। শ্মশান আসলে এক ধরণের বৈরাগ্যের জায়গা। এখানে বসে মাত্র ১০ মিনিট থাকতে পারলে আমরা জীবন ও মৃত্যু নিয়ে নতুন করে ভাবতে পারি। আমরা দেহ নিয়ে অনেক অহংকার করি, কিন্তু যখন প্রাণীটি দেহ ছেড়ে চলে যায়, তখন তার দেহ শ্মশানে পরিণত হয় ভস্মে। জ্ঞানীরা এই সত্যটা বুঝে, দেহের সুখ ত্যাগ করে সাধনায় মন থাকে।
শ্মশান
তাই সাধনা ও মেডিটেশনের জন্য
অনেক বছর ধরে একটি
কেন্দ্র হয়ে আছে। মৃত্যু
কাউকে রেহাই দেয় না। সুন্দরী
মেয়ের মৃত্যুর পর তার দেহও
শ্মশানে মাটিতে মিশে যায়, ঠিক
যেমন ugly বা বিকৃত মুখের
মানুষের দেহও একইভাবে শেষ
হয়। মৃত্যুর ক্ষেত্রে কোনো প্রভেদ নেই।
ধনী কিংবা গরীব, সবই মৃত্যুতে শেষ
হয়। সাধকরা এই সত্যটি জানে।
কালের হাত থেকে কেউ
মুক্ত নয়। তাই মহামায়া
কালী বা সময়ের শক্তির
উপাসনায় তারা নিজেদের নিয়োজিত
করেন।
শ্মশানে শবদাহ করার কারণ:
শ্মশানে
শবদাহ হিন্দু ধর্মের একটি পুরনো প্রথা।
এই রীতি অনুযায়ী, মৃত্যুর
পর দেহকে আগুনে দাহ করা হয়।
বিশ্বাস করা হয়, শরীর
পাঁচটি উপাদান — মাটি, জল, আগুন, বায়ু,
ও আকাশ দিয়ে গঠিত।
দাহের পর শরীর আবার
প্রকৃতির সঙ্গে মিশে যায়। এটা
আত্মার মুক্তির সাথেও জড়িত। হিন্দুধর্মে আত্মাকে অমর মনে করা
হয় এবং দেহকে এর
বাহন হিসেবে দেখা হয়। মৃত্যুর
পর আত্মা নতুন শরীর খোঁজার
জন্য চলে যায়, তাই
শবদাহের প্রয়োজন আছে।
দাহের
ফলে দেহ দ্রুত পচে
গন্ধ ছড়ায় না, যা
পরিবেশের জন্য ভালো। জীবাণু
ছড়ানো কমে যায়, বিশেষত
জনবহুল এলাকায়। আগুন সব অপবিত্রতা
ধ্বংস করে। দাহের সময়
পরিবারের সদস্যরা মৃত্যুর বাস্তবতা মেনে নিতে পারেন
এবং প্রার্থনা করেন আত্মার শান্তির
জন্য। শ্মশানে আগুনে দেহ অর্পণের সঙ্গে
সঙ্গে, মানুষ জীবনের ক্ষণস্থায়িত্ব সম্পর্কে বুঝতে পারে। তাই শ্মশানে শবদাহ
একটি আধ্যাত্মিক এবং সামাজিক দায়িত্ব
হিসেবে পালন করা হয়।
দাহ সংস্কার কি?
দাহ
সংস্কার হিন্দু ধর্মের এক গুরুত্বপূর্ণ রীতি।
এটা মৃত্যু পরবর্তী ষোড়শ সংস্কারের একটি
অংশ। হিন্দুরা বিশ্বাস করে, আমাদের দেহ
পঞ্চভূত – মাটি, জল, বাতাস, আগুন
এবং আকাশ – দিয়ে তৈরি। মৃত্যুর
পর দেহকে আগুনের মাধ্যমে প্রকৃতির কাছে ফিরিয়ে দেয়ার
উদ্দেশ্য হলো দাহ সংস্কার।
আগুনকে পবিত্র এবং শুদ্ধ শক্তি
হিসেবে দেখা হয়। দাহের
মাধ্যমে দেহের অপবিত্রতা দূর হয় এবং
আত্মা মুক্তি পায়।
এই প্রথা আত্মার পুনর্জন্ম বা পরকালীন যাত্রায়
সহায়তা করে। মৃতদেহ পচে
দুর্গন্ধ সৃষ্টি না করে, তাই
স্বাস্থ্য ঝুঁকি কম থাকে এবং
জীবাণুর বিস্তারও রোধ হয়। শ্মশানে
আত্মীয়-স্বজন সেখানে উপস্থিত হয়ে মৃত ব্যক্তির
প্রতি শ্রদ্ধা জানায় এবং ধর্মীয় আচার
পালন করেন। পুরোহিত বৈদিক মন্ত্র পাঠ করেন যাতে
আত্মার শান্তি হয়।
হিন্দু দর্শনে, মৃত্যুকে জীবনের চক্রের অংশ হিসেবে দেখা হয় এবং দাহ সেই চক্রকে সম্পূর্ণ করে। মৃতদেহের ছাই ও অস্থি নদীতে বিসর্জন দেয়া হয়, যা আত্মার মুক্তির আরেকটি ধাপ। এটা একটি সামাজিক আচারও, যেখানে পরিবার ও সমাজ একত্র হয়ে শোক ভাগাভাগি করে। দাহ সংস্কার মানুষের জীবন এবং মোক্ষের ভাবনাকে উপলব্ধি করতে সাহায্য করে। এটি ধর্ম, সংস্কৃতি এবং পরিবেশের সব কিছু মিলিয়ে গঠিত। তাই, দাহ কেবল একটি ধর্মীয় রীতি নয়, বরং এটি মানব জীবনের অন্তিম পথযাত্রার অংশ। এই বিশ্বাস থেকেই দাহ সংস্কার প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে পালিত হয়ে আসছে।
আত্মার মুক্তি ও পুনর্জন্ম: হিন্দু দর্শনে আত্মাকে অমর এবং চিরস্থায়ী ভাবা হয়। জীবনের শেষ হওয়া মানে কেবল শরীরের শেষ, আত্মার নয়। আত্মা দেহ বদলায়, যেমন মানুষ পুরনো পোশাক পরা বন্ধ করে নতুন পোশাক পরে। এই বদলকেই আমরা পুনর্জন্ম বলি। আত্মা আগে কি কেটেছে তার ওপর নতুন দেহ পায়। ভালো কাজ করলে ভাল জন্ম হয়, আর খারাপ কাজ করলে কষ্টের জীবন। কর্ম ও পুনর্জন্মের এই চক্র থেকে মুক্তি দেয় 'মোক্ষ' বা আত্মার মুক্তি। মোক্ষ পেলে আত্মা আর পুনর্জন্ম নেবে না, বরং আল্লাহর সঙ্গে এক হয়ে যাবে। মুক্তির পথে মানুষের ধর্ম, সাধনা, জ্ঞান এবং ভক্তি নিয়ে চলা। আত্মার মুক্তি হিন্দু জীবনের বড় লক্ষ্য। পুনর্জন্মকে ঈশ্বরের বিচার হিসেবে দেখা হয়। আত্মা যতবার জন্ম নেয়, প্রতি বার সে কিছু শিখে এবং ভালো হয়। আত্মার মুক্তি মানে এই বিশ্ব ও পরলোকের বাঁধন থেকে মুক্তি। এই বিশ্বাস মানুষকে নৈতিক জীবন যাপন করতে উৎসাহিত করে। পুনর্জন্ম ও মুক্তির ধারণা জীবনকে একটি ধারাবাহিক যাত্রা হিসেবে তুলে ধরে।
শ্মশানে দাহ করার বৈজ্ঞানিক কারণ ও শাস্ত্রীয় ব্যাখ্যা
শ্মশানে
দাহ করার প্রথা হিন্দু
ধর্মে অনেক দিনের পুরনো।
এর পেছনে কেন যুক্তি আছে,
সেটা জানাচ্ছি।
মৃতদেহ
পচতেই ব্যাকটেরিয়া আর ভাইরাস তৈরি
হয়। যদি সেগুলো সঠিকভাবে
নিষ্পত্তি না করা হয়,
এটা সংক্রমণ ছড়াতে পারে। দাহ করলে যেগুলো
চলে যায়, কারণ আগুন
সব মারে। মৃতদেহ তখন দ্রুত ভস্ম
হয়ে যায়। কবর দিলে
এই প্রক্রিয়া অনেকটাই ধীর হয় এবং
জমিকে দূষিত করতে পারে। কাঠের
ধোঁয়া পরিবেশে কিছু প্রভাব রাখে,
কিন্তু এখন আধুনিক বৈদ্যুতিক
চুল্লি ব্যবহারে সেটা কমানো সম্ভব।
এছাড়া,
দাহের পর মৃতদেহের কিছু
অবশিষ্টাংশ থাকে না, তাই
দুর্গন্ধ বা দূষণ হয়
না। যাদের প্রিয়জন মারা যায়, তাঁদের
জন্য দাহ একটি প্রতীকী
বিষয়—যেখানে বুঝতে পারেন যে প্রিয়জন চলে
গেছে। এটা মানসিকভাবে বিচ্ছেদকে
সহজ করে দেয়।
হিন্দু
দর্শনে, দেহ পঞ্চতত্ত্ব দিয়ে
গঠিত। তাই, মৃত্যুর পর
আগুনের মাধ্যমে সেই উপাদানে ফিরিয়ে
দেওয়া হয়। শাস্ত্রেও বলা
আছে, দাহ করলে আত্মা
তাড়াতাড়ি দেহ ছেড়ে চলে
যায়, যা পুনর্জন্ম বা
মুক্তির দিকে নিয়ে যায়।
কবর দিলে আত্মা দেহের
প্রতি আকৃষ্ট হয়ে থাকতে পারে।
পুরাণে আছে, মানুষ যেমন
পুরোনো কাপড় ছেড়ে নতুন
নেয়, তেমনি আত্মা পুরাতন দেহ ছেড়ে নতুন
দেহ নেয়।
দাহ
করার প্রথা মানুষের জন্য মৃত্যুর সত্যতা
ও জীবনের অস্থিরতা সম্পর্কে সচেতন করে। এটি একটি
বিজ্ঞানসম্মত ও শাস্ত্রীয় পদ্ধতি,
যা মৃতদেহের সুষ্ঠু নিষ্পত্তি, রোগ প্রতিরোধ এবং
আত্মার মুক্তির বিষয়ে শিক্ষা দেয়।
উপসংহার:কাম,
ক্রোধ, লোভ, হিংসা, অহংকার,
আর বাসনা - এগুলো সবই শরীরের অনুভূতি।
তবে, আত্মা এগুলোর সাথী নয়। যখন
শরীরের মৃত্যু হয়, তখন এই
রিপুগুলো পুড়ে যায়। রিপুর
বিনাশ হলে সাধকের মনে
ভক্তির জন্ম হয়। তাই,
শরীর, যা রিপুদের খেলার
মাঠ, তা আগুনে পুড়ে
যায়। মানুষের জন্ম নিয়ে যদি
পশুর মতো আচরণ করি
এবং এসব রিপুর দাস
হয়ে থাকি, তবে জীবনের কোন
মানে নেই। ঘুম থেকে
উঠুন! আপনার ভিতরে সত্যিকারের আনন্দ আছে, তাকে জাগানোর
চেষ্টা করুন এবং জন্ম
ও মৃত্যুর চক্র থেকে মুক্ত
হয়ে যান।
0 Comments