ঈশ্বর কেন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন? ধর্মীয় ও দার্শনিক ব্যাখ্যা

 ঈশ্বর কেন এই জগৎ সৃষ্টি করেছেন? — এই প্রশ্নটি অনেক পুরনো এবং বিভিন্ন দর্শন, ধর্ম এবং আধ্যাত্মিক প্রথায় এর উত্তর খোঁজার চেষ্টা হয়েছে। হিন্দু ধর্মের বিভিন্ন গ্রন্থ ও দর্শনে এ নিয়ে নানা ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। 

ঈশ্বর কেন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন
ঈশ্বর কেন পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন

👉ব্যাখ্যা ১_এটি অনেকের জন্য একটি সাধারণ প্রশ্ন: ঈশ্বর কেন এই পৃথিবীটি তৈরি করেছেন? বিষয়টিকে সহজ করে বলতে গেলে, এটি বেশ বড় এবং অনেকের পক্ষে বোঝা কঠিন হতে পারে। তাই আমি এখানে সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। প্রাচীন বেদ অনুযায়ী, দুটি জগত আছেএকটি আধ্যাত্মিক এবং একটি বস্তুগত, যেখানে আমরা আছি। বেদে আধ্যাত্মিক জগতের সম্পর্কে কিছু তথ্য পাওয়া যায়, যেখানে স্বর্গের চিত্র এবং ঈশ্বরের রাজ্যের বর্ণনা দেয়া আছে। যোগ দর্শনে পতঞ্জলি মুনির ব্যাখ্যা আমাদের এই বিষয়ে অনেক সুন্দর ধারণা দেয়।

যেকোনো কাজের তিনটা কারণ হয়। নিমিত্ত কারণ, উপাদান কারণ, আর সাধারণ কারণ।

নিমিত্ত কারণ হলো কর্তা (who), উপাদান কারণ হলো কাজটা (what), এবং সাধারণ কারণ হলো কেন (why) করতে হচ্ছে।

সহজ ভাবে বললে, যদি আমরা একটা বাড়ির নির্মাণকে চিন্তা করি, তাহলে এতে মিস্ত্রি হচ্ছে মূল ব্যক্তি, আর উপাদানগুলো হচ্ছে ইট, বালু, সিমেন্ট, রড। আর যাঁরা ওই বাড়িতে থাকবেন, তারাও একটা কারণ।

ত্রৈতবাদ অনুযায়ী, সাধারণ কারণ হল জীবাত্মা। কারণ, ঈশ্বর এই জগতকে কখনোই ভোগ করেন না। তাই এই জগৎ তৈরি হয়েছে জীবাত্মার ভোগের জন্য।

সূত্র - এটি দর্শনের একটি দৃষ্টি। (যোগ দর্শন ২।২১)

 শব্দার্থ - (তদ্-অর্থঃ) অপবর্গের জন্য (এব) অবশ্যই (দৃশ্যস্য) দৃশ্যের (আত্মা) স্বরূপ হয় বা ওই জীবাত্মার ভোগ।

 সূত্ৰাৰ্থ - অপবর্গ সিদ্ধ করার জন্য হয় এবং দৃশ্যের স্বরূপ জীবাত্মার ভোগ।

উপরের সূত্রগুলো নিয়ে কথা বললে বলবো, এই দৃশ্যের প্রয়োজন কী? এখানে বলা হয়েছে, ঈশ্বর এই দৃশ্য সৃষ্টি করেছেন যাতে জীবাত্মা অন্যরকম ভোগ এবং মুক্তির জন্য প্রয়োজনটা মেটাতে পারে। আমাদের এই জগতে তিনটা জিনিস আছে: ঈশ্বর, জীব প্রকৃতি। ঈশ্বর সব কামনা থেকে মুক্ত, তাই তাঁর কাছে এই দৃশ্যের কোনো প্রয়োজন নেই। প্রকৃতি নিজে জড়, তাই সে নিজে কিছু উপভোগ করতে পারে না। কিন্তু জীবাত্মার আবার আনন্দের অভাব আছে, তাই সে এই দৃশ্যকে ব্যবহার করে। সূত্র: যোগ দর্শন ভাষ্য - আচার্য কপিল আর্য।

ব্যাখ্যা ২_ঈশ্বর কেন এই বিশ্ব, পৃথিবী, আর প্রাণীজগত তৈরি করলেন? আব্রাহামিক ধর্মালম্বীরা ধর্মের লোকেরা বলছে, সৃষ্টিকর্তা আমাদের তৈরি করেছেন যাতে আমরা তাঁর ইবাদত করি। কিন্তু যদি এটা সত্যি হয়, তাহলে সৃষ্টিকর্তা শুধু একটি শক্তিশালী শাসক। বৈদিক ঈশ্বর এমন নন। তিনি মহত্তম। এবং যিনি মহত্তম, তিনি কোনো উপাসনা চান না। তিনি উপাসনা না করলে দোযখে পাঠানও না। তাহলে কেন ঈশ্বর এই মহাবিশ্ব তৈরি করলেন? কারণ মহান বৈদিক ঈশ্বর চেয়েছিলেন, তিনি যেন সব জায়গায়, সবাইর মাঝে থাকতে পারেন। এ নিয়ে ছানে্দেগ্য উপনিষদের একটি শ্লোক দারুণভাবে বিষয়টা ব্যাখ্যা করেছে।

(ছান্দোগ্য উপনিষদ ৬.২.৩):

तदेक्षत बहु स्यां प्रजायेय इति तत् तेजः असृजत ।

तत् तेजः ऐक्षत बहु स्यां प्रजायेय इति । तदापः असृजत ।

বাংলা অনুবাদ:

সে (সচ্চিদানন্দ ব্রহ্ম) চিন্তা করল — "আমি এক, বহু হই, আমি সৃজন করব।" এই ভাবনা করে সে তেজ (অগ্নি) সৃষ্টি করল। তারপর সেই তেজও চিন্তা করল — "আমি বহু হই, আমি সৃষ্টি করব।" তখন সেই তেজ জলের সৃষ্টি করল। ব্যাখ্যা:এখানে সৃষ্টি-তত্ত্ব ব্যাখ্যা করা হয়েছে। এই অংশটি বোঝায় যে —ব্রহ্ম এক ও অদ্বিতীয় সত্তা। কিন্তু সৃষ্টি ইচ্ছায় ব্রহ্ম নিজেকে বহুত্বে বিকাশ করতে চাইলেন — ফলে প্রথমে তেজ বা অগ্নি সৃষ্টি হল। তারপর সেই তেজও সৃষ্টির ইচ্ছা করে জল সৃষ্টি করল। এই উপাখ্যান আধ্যাত্মিকভাবে বোঝায় — সৃষ্টি একটি ধাপে ধাপে প্রসারমান প্রক্রিয়া, যেখানে মূল তত্ত্ব এক, কিন্তু তা জগতের বহুমাত্রিক রূপ ধারণ করেছে।

(তৈত্তিরীয় উপনিষদ ২.৬.১)

सः अकामयत — बहु स्याम् प्रजायेय इति।

सत् तपः तप्यत।

सः तपस्तप्त्वा इदम् सर्वम् असृजत।

यदिदम् किञ्च।

तत् सृष्ट्वा तदेवानुप्राविशत्।।

 বাংলা অনুবাদ:

তিনি (পরম ব্রহ্ম) ইচ্ছা করলেন — "আমি এক, কিন্তু বহু হই; আমি সৃষ্ট হও।"

তিনি তপস্যা করলেন। তপস্যার পর তিনি এই সমস্ত কিছু সৃষ্টি করলেন — যা কিছু আছে এই জগতে।

এগুলো সৃষ্টি করার পর, তিনি তাতে নিজেই প্রবেশ করলেন।

ব্যাখ্যা: এই মন্ত্রটি উপনিষদীয় সৃষ্টি তত্ত্বের এক মহামূল্যবান বর্ণনা, যার মূল পয়েন্টগুলো হল: "সঃ অ কাময়ত" — সর্বপ্রথম ব্রহ্ম ইচ্ছা করলেন, এটি "ইচ্ছার সৃষ্টি" বা ইচ্ছাশক্তির মাধ্যমে সৃষ্টির সূচনা বোঝায়। "বহু স্যাং প্রজায়েয়" — তিনি এক, কিন্তু সেই একত্ব থেকে বহুত্বের সৃষ্টি করতে চাইলেন। "তপঃ তপ্ত্বা" — সৃষ্টি করার পূর্বে তিনি তপস্যা করলেন, অর্থাৎ এক ধরণের আত্ম-সাংকেতিক প্রস্তুতি বা শক্তি-সংহতি। "ইদং সর্বং আসৃজত" — তারপর তিনি সমগ্র বিশ্ব সৃষ্টি করলেন। "তদেব অনুপ্রাবিশৎ" — সবশেষে তিনি এই সৃষ্টির ভেতরে নিজেই প্রবেশ করলেন, অর্থাৎ সৃষ্টির অন্তর্নিহিত চেতনা ও প্রাণরূপে নিজেকে স্থাপন করলেন। এই "অনুপ্রবেশ" হল আত্মা বা চেতনার প্রবেশ, যা জীবজগতে ব্রহ্মের অস্তিত্বকে বোঝায়।

হিন্দুধর্ম মতে পৃথিবীর সৃষ্টির ছবি
হিন্দুধর্ম মতে পৃথিবীর সৃষ্টির ছবি

 (ঋগ্বেদ ১০.৯০.৪) ত্রিপাদূর্ধ্ব উদৈত্‌ পুরুষঃ, পাদোऽস্য ইহাভবৎ পুনঃ।

ততো বিষ্বং ব্যক্রামৎ, সাশনানশনে অধি॥

বাংলা অনুবাদ:

পুরুষের (ব্রহ্মস্বরূপ) তিন চতুর্থাংশ অংশ (ত্রিপাদ) আধ্যাত্মিক জগতে ঊর্ধ্বে অবস্থান করে,

আর তাঁর এক চতুর্থাংশ এই জাগতিক জগতে পুনরায় আবির্ভূত হয়।

এই (এক-পদ অংশ) সমস্ত বিশ্বে বিস্তৃত হয়ে যায় — জীব, জড়, আহারী ও অনাহারী সকলের মধ্যে।

ঈশ্বর কেন এই জগৎটি তৈরি করেছেন? এটা মানুষ প্রশ্ন করে অনেক সময়। হিন্দু দর্শনে এর উত্তর পাওয়া যায় বেদ, উপনিষদ, গীতা এবং পুরাণে। উপনিষদে বলা হয়েছে, পরম ব্রহ্ম, যিনি এক এবং অদ্বিতীয়, তিনি চেয়েছিলেন— 'আমি এক, বহু হই'। এই থেকেই সৃষ্টি শুরু হয়। এই সৃষ্টি কোনও অভাব পুরণের জন্য নয়, বরং এটি ব্রহ্মের স্বাভাবিক প্রকাশ। ভক্তিমূলক দর্শনে এটাকে বলা হয় 'লীলা'— ঈশ্বর আনন্দের জন্য এই জগৎ তৈরি করেছেন। তিনি জীব ও আবদার রূপে নিজের খেলায় অবতীর্ণ। আবার আদ্বৈত দর্শনে বলা হয়, জগৎ আসলে মায়া— বিভ্রান্তির বহুত্ব, যা আত্মসত্তার চেতনার মধ্যে উপলব্ধি হয়। গীতায় আছে, এই জগৎ হল কর্মক্ষেত্র, যেখানে জীব পূর্বজন্মের কাজ অনুযায়ী জন্ম নেয়, কাজ করে আর মুক্তির পথ খোঁজে। ঈশ্বর সৃষ্টি করেছেন যাতে জীব নিজের আসল রূপ চেনে, আত্মজ্ঞান অর্জন করে এবং জন্ম-মৃত্যুর চক্র থেকে বেরিয়ে আসে। তাই জগৎ কেবল বস্তু নয়— এটা ঈশ্বরের লীলা, আত্মার শিক্ষালয় এবং সত্য উপলব্ধির পথ।

সনাতন ধর্ম মতে পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস

সনাতন ধর্ম অনুযায়ী, পৃথিবী সৃষ্টির ইতিহাস একটা গভীর দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক ভাবনার উপর ভিত্তি করে। এই ধর্মে বলা হয়, সৃষ্টি কোনও আকস্মিক ঘটনা নয়; এটি পরম ঈশ্বরের ইচ্ছা ও খেলার ফল। উপনিষদে বলা হয়েছে, পরম ব্রহ্ম ইচ্ছা করলেন, “আমি এক, কিন্তু বহু হব।” এই ইচ্ছা থেকে তিনি তপস্যা করে তেজ, জল ও অন্ন — এই তিনটি উপাদান তৈরি করলেন। এগুলোর থেকেই মহাবিশ্ব, দেবতা, প্রাণী এবং মানুষ গঠিত হলো।

পুরাণের মতো বিষ্ণুপুরাণ, ভাগবতপুরাণ এবং বেদ অনুযায়ী, প্রথমে সৃষ্টি হয় মহাজল (প্রকৃতি), এরপর সেই জলে বিষ্ণু বা নারায়ণ শয়ন করেন, আর তাঁর নাভি থেকে বের হন ব্রহ্মা — যিনি বিশ্বসৃষ্টির দেবতা। ব্রহ্মা সৃষ্টির কাজ শুরু করেন। প্রথমে মানসপুত্র আসে, পরে বিভিন্ন লোক, দেবতা, রাক্ষস, প্রাণী ও মানুষ সৃষ্টি হয়। 

এইভাবে, সনাতন ধর্মে পৃথিবীর সৃষ্টি একটি চলমান কসমিক প্রক্রিয়া — যা অনাদি ও অনন্ত, এবং এর উদ্দেশ্য জীবনের আত্মউন্নয়ন ও মোক্ষের পথ তৈরি করা। এই দৃষ্টিতে, জগত একটি ঈশ্বরীয় নাট্যমঞ্চ, যেখানে আত্মা নিজের প্রকৃতি বুঝতে জন্ম নেয়।


শেষে, এটা বলা যায় যে ঈশ্বর জগত এবং জীবনের স্রষ্টা। তিনি সুন্দর এবং পবিত্র, সব জায়গায় আছেন। তিনি শূন্যতা থেকে সবকিছু তৈরি করেছেন এবং সেটা তাঁর গৌরবের জন্য। ঈশ্বরের সব সৃষ্টিই অসাধারণ। সব কিছুতে একটি সম্পর্ক এবং নির্ভরতা রয়েছে। সৃষ্টির যত্ন নেওয়া আমাদের দায়িত্ব। সৃষ্টিকে ভালোবাসার মাধ্যমে আমরা ঈশ্বরের প্রতি আমাদের ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারি, তাই না?



Post a Comment

0 Comments