সংস্কৃত শব্দ 'রিপু' মানে শত্রু। হিন্দু দর্শন ও ধর্মশাস্ত্রে, রিপু হল সেই মানসিক বা চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো যা মানুষের আত্মোন্নতির পথে বাধা দেয়। এগুলোকে ‘অন্তঃশত্রু’ বা ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ বলা হয়।
ষড়রিপুঃ ষড়র মানে ছয় আর রিপু মানে শত্রু যদিও অনেক ক্ষেত্রে সাতটির কথা উল্লেখ পাওয়া গেছে। তাই ষড়রিপু হলে ছয়টা শত্রুর কথা বলা হচ্ছে। যখন মানুষের মন এই শত্রুদের দ্বারা আক্রান্ত হয়, তখন সে অনেক ভুল কাজ করে ফেলে, যা পরে পাপ হিসেবে ধরা হয়। এই ছয়টা শত্রু হল: কাম, ক্রোধ, লোভ, মদ, মোহ এবং মাৎসর্য।
![]() |
ষড়রিপু |
১. কাম – ইন্দ্রিয়সুখ বা কামনা (lust)- সাধারণত কামনা বা ভোগের ইচ্ছাকে বোঝায় কাম রিপু । যখন মানুষ জীবনে সুখ এবং সমৃদ্ধির জন্য অতিরিক্ত কিছুর দিকে আকৃষ্ট হয়, তখন সেটি কাম বলা হয়। এছাড়া, যেকোনো ব্যক্তির প্রতি আকর্ষণ বা তার শরীর ভোগ করার ইচ্ছাকেও কাম হিসেবে ধরা হয়। এই কাম রিপুই আমাদের জীবনে অন্যান্য পাঁচটি রিপুর সৃষ্টি করে।
👉 কাম রিপু থেকে মুক্তির উপায়: কাম প্রথমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলো দিয়ে মন এবং বুদ্ধিকে আকৃষ্ট করে। ইন্দ্রিয়, মন এবং বুদ্ধি হল এই রিপুর আবাস। তাই প্রথমে আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে যাতে কামের প্রভাব কমানো যায়। যারা এই কামকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে, তারা জীবনে সুখ, সমৃদ্ধি এবং সাফল্য পেতে পারবে।
২. ক্রোধ – রাগ বা অস্থিরতা(anger)- রোষ বা রাগ মানে হল ক্রোধ। এটা অনেক ধরনের হতে পারে যেমন চোট, ক্ষিপ্ততা, কিংবা প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছা। আসলে, আমাদের মধ্যে রাগ এবং অনুরাগ দুই ধরনের ক্রোধ থাকে। কখনো আমরা কামনায় এত গভীর হয়ে যাই যে সেটি আমাদের চিন্তাভাবনাও নিয়ন্ত্রণ করে। যখন কামনা পূর্ণ হয় না, তখন আমরা অন্যদের গীবত গাইতে করতে শুরু করি এবং আমাদের কষ্টকে প্রকাশ করতে গিয়ে তাদেরকে আঘাত করতে চাই। এটা আসলে আমাদের ভিতরের ক্রোধের একটা বিকার। কখনো কখনো আমাদের অহংকারে আঘাত পড়লে, সেই ক্ষোভও আমাদের ক্রোধের রূপ নেয়।
👉ক্রোধ রিপু থেকে মুক্তির উপায়ঃ ক্রোধ আসলে শক্তিশালী একটা অনুভূতি। যদি আমরা ক্রোধকে ঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ না করতে পারি, তাহলে জীবনে কোনো কাজে সফল হওয়া কঠিন। ক্রোধকে সামলে নিতে পারলে ভদ্রতা, শিষ্টাচার এবং আত্মবিশ্বাস বাড়ে, আর তখন নতুন কিছু শিখতেও সুবিধা হয়। ক্রোধকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে ধৈর্য, সহনশীলতা ও ক্ষমার মানসিকতা গড়ে তুলতে হবে।
৩. লোভ – অত্যধিক লোভ বা স্বার্থপরতা(Greed): সেই অনুভূতি হল লোভ , যখন আমরা কিছু চাওয়ার পর আরও বেশি কিছু পাওয়ার আশা করি। অনেক সময় জানি যে, এটা ঠিক নয়, তবুও লোভের কারণে আমরা সেই জিনিসের দিকে ছুটে যাই।
👉লোভ থেকে মুক্তির কয়েকটি উপায়ঃ লোভ খুব শক্তিশালী, আর এটা মানুষের বিবেক ও মানবিকতা হারিয়ে ফেলার কারণ হতে পারে। লোভ নিয়ন্ত্রণ করতে হলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ রাখতে হবে এবং অভ্যাসের মাধ্যমে সংযমের চর্চা করতে হবে। এভাবে, লোভকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব।
৪. মদ – অহংকার বা গর্ব (Arrogance/Vanity):
অহংকার এমন এক মানসিকতা, যেখানে একজন ব্যক্তি নিজেকে সবসময় অন্যদের থেকে শ্রেষ্ঠ ভাবতে শুরু করে এবং বাকিদের তুচ্ছ মনে করে। এই অহংকারকেই বলা হয় ‘মদ’। মদের প্রকৃতি হলো গর্ব, দাম্ভিকতা ও এক ধরনের আত্মভরসার ভারী ভাব, যা মানুষের কামনা, ক্রোধ ও লোভেরই এক বিকৃত রূপ। অহংকার মানুষকে বিভ্রান্ত করে ফেলে এবং তার প্রকৃত স্বরূপকে আড়াল করে রাখে। অহংকারী ব্যক্তি প্রায়শই আত্মসন্তুষ্টির মধ্যে ডুবে থাকেন, যা তার নিজের সম্পর্কে সঠিক উপলব্ধি গঠনে বাধা সৃষ্টি করে। ফলে সে ধীরে ধীরে চারপাশের বিশ্বকে তুচ্ছ মনে করতে শুরু করে এবং বাস্তব থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। অহংকার সব অর্জিত সম্পদকে ঝড়ে মুছে দিতে পারে। কথায় আছে, অহংকার পতনের মূল। অনেক সময় দেখা যায়, মানুষ অনেক কষ্ট করে, ত্যাগ করে কিছু অর্জন করে আবার অহংকারের জন্য সেটি ধরে রাখতে পারে না। এভাবে অহংকার ধীরে ধীরে তাদের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। অহংকারী মানুষ আত্মপ্রতিষ্ঠার জন্য অনেক চেষ্টায় ব্যস্ত থাকে। তারা সর্বত্র সাফল্য চান, আর এতে নিজের স্বর্ণালী অবস্থান প্রকাশ করার তাগিদে পড়েন। কিন্তু এতে তারা স্বীকৃতি পায় না, বরং আরও ছোট হয়ে যান। অহংকারের অধিকারী মানুষ সাধারণত ঈশ্বরের প্রতি ভক্তি রাখেন না, তাদের দ্রুতই মাথা গরম হয়ে যায় এবং এক সময় তারা মানুষের কাছে হেয় হয়ে পড়েন।
👉 অহংকার থেকে মুক্তির উপায় - অহংকার দূর করতে হলে আমাদের অবশ্যই ঈশ্বরে বিশ্বাস রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে, জীবনে যা কিছু পেয়েছি, তা সবই ভগবানের দান। সমাজের ধনী লোকদের দিকে না তাকিয়ে, গরীব ও অসচ্ছল মানুষের দিকে নজর দিলে ধীরে ধীরে অহংকার কমে আসবে। আরেকটা অসাধারণ উপায় হল আসল জ্ঞান অর্জন করা, কারণ যত বেশি আমরা প্রকৃত জ্ঞান পাবো, তত কম হবে অহংকার। আর নকল জ্ঞান যত বাড়বে, অহংকারও ততই বাড়বে।
৫.মোহ – বিভ্রান্তি রিপুঃ (attachment) : স্বপ্নকে সত্যি মনে করা হলো মোহ আর মাঝে মাঝে কিছু বিষয়কে ভুল ধারণা করে তাদের কাছাকাছি থাকা। যেমন, অর্থ, রূপ, বা নেশার মোহ। মোহ হচ্ছে এসবের প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি। যখন আমরা কোনো কিছু বা ব্যক্তির প্রতি আমাদের স্বাভাবিক অধিকার মনে করি এবং সেটাকে অন্যের কাছে দিতে চাই না, তখন এটা মোহের কারণে হয়ে থাকে।
👉মোহ থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায় হলো: জ্ঞানী মানুষের উপদেশ, ভালো সঙ্গী থাকা এবং সৎগুরুর সাথে সময় কাটানো। যখন মানুষ মোহের কাছে বন্দী হয়, তখন যদি তারা তাদের মনের একটু জায়গায় প্রকৃতিকে এবং ঈশ্বরকে ভালোবাসার মোহ তৈরি করতে পারে, তাহলে ধীরে ধীরে মোহ থেকে মুক্তি পায় এবং তাদের জীবনে শান্তি আসে।
৬. মাত্সর্য – হিংসা (Envy/Jealousy):
অন্যের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব এবং অসুস্থ ঈর্ষাই হলো হিংসা বা মাত্সর্য। এই রিপুর অন্যতম লক্ষণ হলো পরশ্রীকাতরতা—অর্থাৎ, অন্যের মঙ্গল বা সাফল্য সহ্য করতে না পারা। হিংসা কেবল মানসিক অস্থিরতাই সৃষ্টি করে না, বরং ব্যক্তিজীবনেও তা অশান্তির বিষ ছড়িয়ে দেয়। পরশ্রীকাতরতার প্রকাশ ঘটে মূলত তিনটি রূপে—প্রথমত, অন্য কেউ সাফল্য অর্জন করলে নিজের অন্তরে জ্বালা অনুভব করা; দ্বিতীয়ত, কারও ভালো কিছু দেখলে তার প্রশংসা না করে বরং খুঁত ধরার চেষ্টা করা কিংবা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করা; তৃতীয়ত, যোগ্য বা উর্ধ্বতন ব্যক্তির প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন কিংবা বিরুদ্ধ মনোভাব পোষণ করা। এই মাত্সর্য ব্যক্তি ও সমাজ—উভয়ের সুস্থ বিকাশে বাধা সৃষ্টি করে। হিংসার কারণে একজন মানসিকভাবে ভ destroyed হতে পারে। অন্যের সুখ সহ্য করতে না পারা এবং খুব কাছের মানুষকেও সন্দেহের চোখে দেখা এই অনুভূতি থেকে আসে। হিংসায় আক্রান্ত মানুষ অন্যের দুঃখে আনন্দিত হয় এবং সফলতায় ক্ষুণ্ন হয়। তারা গোপনে অন্যের ক্ষতি করার চেষ্টা করে। হিংসার মূলে আছে অভাববোধ, যা মানুষকে অশান্ত করে। তাই, আমাদের উচিত এই রিপুর বিরুদ্ধে নিজেকে সংযত রাখা এবং নিজেদের মনকে নিয়ন্ত্রণে রাখা। যারা এই রিপুর পতন ঘটাতে পারে, তারা সাধারণ মানুষের চোখে সত্যিকারভাবে বড় হয়ে ওঠে।
👉 ঈর্ষা থেকে মুক্তির বেশ কিছু উপায় আছে। প্রথমত, আমাদের একটা ভাল সমাজ আর সমান বিতরণ প্রয়োজন। চাহিদা আর যোগানের সামঞ্জস্য রাখা খুব জরুরি। এছাড়া, যদি আমরা আমাদের অনুভূতি ও বিবেচনাকে কাজে লাগিয়ে বাস্তবের সাথে যুক্ত হতে পারি, তাহলে ঈর্ষাকে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। আমাদের মনকে শান্ত আর পরিষ্কার রাখতে হবে যাতে ষড়রিপুর প্রভাব না পড়ে। মনে খারাপ চিন্তা আসলে মনটা নোংরা হয়ে যায়, আর যদি ভালো চিন্তা আসে, তাহলে সেটা পরিষ্কার হয়।
সপ্ত রিপু বা সাতটি রিপুকে হিন্দু দর্শনে গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়। এগুলো হল:
১. কাম – ইন্দ্রিয়সুখ বা কামনা
২. ক্রোধ – রাগ বা অস্থিরতা
৩. লোভ – অত্যধিক লোভ বা স্বার্থপরতা
৪. মোহ – বিভ্রান্তি
৫. মদ – অহংকার বা গর্ব
৬. মাত্সর্য – হিংসা
৭. আসক্তি – কিছু বা কারোর প্রতি অত্যধিক আকর্ষণ
এই রিপুগুলো মানুষের মনে থাকে এবং আত্মার মুক্তির পথে বড় বাধা মনে করা হয়। ভগবদ গীতা, উপনিষদ এবং বিভিন্ন পুরাণেও এই রিপুগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করার গুরুত্ব নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
0 Comments