ঈশ্বর আছেন কি না? - অস্তিত্বের শক্তিশালী প্রমাণ

ঈশ্বরের অস্তিত্ব একটা বিষয়, যা বহু বছর ধরে ধর্ম, দর্শন আর বিজ্ঞানের মধ্যে আলোচনা হয়ে আসছে। বিজ্ঞান দিয়ে আসলে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়, কারণ এটা আমাদের ইন্দ্রিয় দিয়ে ধরা পড়েনা। তবুও যুক্তি, অভিজ্ঞতা এবং দর্শনের ভিত্তিতে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে অনেকগুলো বিশ্বাসযোগ্য মতামত আছে।

ঈশ্বর আছেন কি না
ঈশ্বর আছেন কি না?


ঈশ্বর আছেন কিনা—হিন্দু ধর্মীয় গ্রন্থের দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ

হিন্দু ধর্মে ঈশ্বর-এর অস্তিত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রাচীন ঋষিরা তাঁদের সাধনার মাধ্যমে যে সত্য বুঝতে পেরেছিলেন, সেটাই হিন্দু ধর্মের বইগুলোতে ঈশ্বর হিসেবে বর্নিত হয়েছে। এখানে ঈশ্বরেরকে দুইভাবে দেখা হয়; একে ব্যক্ত (সাগুণ) এবং অপরটি নির্গুণ (রূপাতীত)। নিচে বিভিন্ন ধর্মীয় গ্রন্থের আলোকে ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো।—


১. বেদ: বেদ হিন্দুধর্মের সবচেয়ে পুরনো এবং গুরুত্বপূর্ণ ধর্মগ্রন্থ। এখানে ঈশ্বরের ব্যাপারে বলা হয়েছে—

“একং সদ্‌ বিপ্রা বহুধা বদন্তি” — (ঋগ্বেদ ১.১৬৪.৪৬)

অর্থাৎ, সত্যটা একটাই, কিন্তু জ্ঞানীরা তাঁকে নানা নামে ডাকেন। উক্তিটির মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে ঈশ্বর এক, কিন্তু তাঁর প্রকাশের অনেক রূপ আছে।


“ঈশা ভাবস্য সর্বস্য” — (ঈশোপনিষদ ১)

এই বক্তব্যের মানে হলো, সারা জগতে ঈশ্বরের উপস্থিতি ও অধিকার রয়েছে।


“যেন সূর্যম্ উদিতং চক্ষুর্বিষয়ং তমঃ” — (যজুর্বেদ)

এর অর্থ হলো, তিনি সেই আলো, যার কারণে সূর্যও জ্বলজ্বলে হয়।


২. উপনিষদ: উপনিষদে ঈশ্বরকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে, যিনি চিরকালীন, সর্বত্র বিরাজমান এবং সকল শক্তির আধার। 


সত্যং জ্ঞানং অনন্তং ব্রহ্ম — (তৈত্তিরীয় উপনিষদ)

এখানে বলা হচ্ছে, ব্রহ্ম সত্য, জ্ঞান ও অনন্ত। 


নেহ নানাস্তি কিঞ্চন — (বৃহদারণ্যক উপনিষদ)

এটির মানে হলো, ব্রহ্মতত্ত্বে কোনো ভিন্নতা নেই; সবটাই এক পরমসত্তার প্রকাশ।

৩. ভগবদ গীতা: গীতা উপনিষদের মূল কথা, যেখানে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে সর্বশ্রেেষ্ঠ ঈশ্বর হিসেবে পরিচয় দিচ্ছেন। 

মত্তঃ পরতরং নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয় — (গীতা ৭.৭) 

অর্থাৎ— হে অর্জুন, আমি ছাড়া আর কেউ নেই; সব কিছু আমার মধ্যেই আছে। 


অহম্ সর্বস্য প্রভবঃ — (গীতা ১০.৮) 

অর্থঃ— আমি সব সৃষ্টির উৎস; সবকিছু আমার থেকেই শুরু।


৪. পুরাণসমূহ: পুরাণে ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপগুলো যেমন ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব এবং দেবী, তাদের গল্প, সৃষ্টি, রক্ষা ও ধ্বংসের বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। এই লেখাগুলোতে ঈশ্বরকে ব্যক্তিগতভাবে দেখা যায়, যা ভক্তদের কাছে খুব কাছের। 

বিষ্ণু পুরাণের কথা বললে, বিষ্ণুরেব বিশ্বং – এর মানে সব কিছুই বিষ্ণুর রূপ, তিনি সব জায়গায় আছেন।

শিব পুরাণে বলা হয়েছে, শিবো হম্ – শিবই চূড়ান্ত শক্তি, যিনি নির্গুণ এবং সগুণ দুইভাবেই পূজ্য।


৫. ব্রহ্মসূত্র: শংকরাচার্য তাঁর কিছু লেখায় ঈশ্বরের তত্ত্বকে ভালোভাবে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন। 

অথাতো ব্রহ্মজ্ঞান — মানে, আমাদের পরম ব্রহ্মের কথা জানা উচিত। 

জন্মাদ্যস্য যত: — যার থেকে সবকিছু আসে, তিনিই ব্রহ্ম বা ঈশ্বর। 

হিন্দু ধর্মের শাস্ত্রগুলোতে ঈশ্বরকে সৃষ্টিকারক, রক্ষক, ধ্বংসক, অন্তর্যামী এবং সচ্চিদানন্দ মানে এক ধরনের শাশ্বত আনন্দ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে। ঈশ্বর আছেন — এ নিয়ে হিন্দু ধর্মে কোনো প্রশ্ন নেই। বরং ঈশ্বরের রূপ, গুণ এবং প্রকাশে নানা মতবাদ তৈরি হয়েছে, যেমন দ্বৈত, অদ্বৈত, এবং বিশিষ্টাদ্বৈত।

সাধারণভাবে ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ

ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করার জন্য বেশি কিছু করতে হবে না। যদি আপনি নিজের অস্তিত্ব নিয়ে একটু ভাবেন, উত্তর পেয়ে যাবেন। এক সময় ছিল যখন আপনি ছিলেন না। পরে, মাতৃগর্ভের অন্ধকারে এক টুকরা পানি রক্তে রূপান্তরিত হয়। তারপর সেটি মাংসে পরিণত হয়। মাংস পরে অস্থিতে বদলে যায়, এরপর চামড়া দিয়ে আচ্ছাদিত হয়। সব শেষে, আত্মা আসে। অনেক সময় সেই গর্ভে থাকতে হয়। খাবারের প্রয়োজন হলে সেখানেও ব্যবস্থা হয়। পৃথিবীতে আসার পর তো আপনি কিছু খেতে পারতেন না, কিন্তু মায়ের দুধ ছিল। ধীরে ধীরে আপনি বড় হয়েছেন এবং একজন সুস্থ মানুষ হিসেবে পরিচিত হয়েছেন। এই সব তো আপনার অস্তিত্বের গল্প। এরপর আমাদের অস্তিত্বে আসার জন্য যে জিনিসগুলো প্রয়োজন, যেমন চোখ, কান, নাক, মুখ, হাত, পা, হৃদপিণ্ড, এবং ব্রেন—এসব নিয়ে বিজ্ঞান অনেকটাই তথ্য জুগিয়েছে যা সত্যিই চমকপ্রদ। মোটকথা, আমাদের পুরো শরীর যাতে সুন্দরভাবে কাজ করে, সেরকমভাবে সব কিছুই তৈরি হয়েছে। প্রত্যেক অঙ্গের স্বাভাবিক কার্যক্ষমতা বজায় রাখতে রক্ত সঞ্চালনের পাশাপাশি আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রক্রিয়া কাজ করে।

আপনার কি সত্যিই মনে হয় এই সবকিছু আপনাআপনি ঘটে? এর পেছনে কি কারো কোনো নির্দেশ, কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই? যদি তাই হয়, তবে মানুষ অসুস্থ হয় কেন? অসুস্থ হলে কেনইবা আমাদের চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়? কেন চিকিৎসা নেওয়ার পরও অনেক সময় সম্পূর্ণ সুস্থতা ফিরে আসে না?
কোনো অঙ্গ মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হলে কেন সেটি কেটে ফেলতে হয়? কেন তখন কেউ সেই অঙ্গের মতোই প্রাণবন্ত, কার্যক্ষম নতুন অঙ্গ তৈরি করে বসাতে পারে না?
কেউ হার্ট অ্যাটাক করলে পৃথিবীর উন্নত চিকিৎসাব্যবস্থাও কেন তাকে সব সময় বাঁচিয়ে রাখতে পারে না? কেন এমন সীমাবদ্ধতা?
এইসব প্রশ্ন কি নিছক কাকতালীয়? নাকি এর মধ্যেই কোনো অদৃশ্য পরিকল্পনার ইঙ্গিত লুকিয়ে আছে?

যেমন চালক ছাড়া গাড়ি চলে না, মাঝি ছাড়া নৌকা ভেসে না, পাইলট ছাড়া উড়ে না বিমান—ঠিক তেমনি করে কি ভাবা যায়, এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এমনিতেই চলছে? প্রতিদিন সূর্য পূর্ব দিকে উদিত হয়, পশ্চিমে অস্ত যায়; চাঁদ ওঠে, ক্ষীণ হয়, আবার পূর্ণ হয়—এই চক্র কি নিজে নিজেই চলছে? কোটি কোটি গ্রহ, নক্ষত্র, গ্যালাক্সি—সবই কি নিখুঁত নিয়মে আপন গতি বজায় রেখে চলছে নিছক কাকতালীয়ভাবে?
কোথাও কোনো বিশৃঙ্খলা নেই, কোনো সংঘর্ষ নেই, নেই কোনো বিরতি। হাজার হাজার বছর ধরে এই মহাজগত চলছে নিরবচ্ছিন্নভাবে, অটুট নিয়মে।
প্রশ্ন জাগে—কে এই মহাব্যবস্থার পরিচালক? কার অদৃশ্য ইশারায় এ বিশ্বযন্ত্র এমন শৃঙ্খলিতভাবে পরিচালিত হচ্ছে?

এই প্রশ্নের উত্তর একটাই—তিনি হচ্ছেন সর্বশক্তিমান স্রষ্টা। যাঁকে কেউ বলে ঈশ্বর, কেউ বলে পরমেশ্বর, কেউ আল্লাহ, কেউবা যিশু খ্রীষ্ট। নাম ভিন্ন হলেও তিনি এক ও অভিন্ন—এই সৃষ্টির মূলে যাঁর ইচ্ছাশক্তি কাজ করছে প্রতিক্ষণে।

এই জগৎ, প্রকৃতি, মহাবিশ্ব—সবই তাঁর অস্তিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এমনকি ক্ষুদ্রতম একটি প্রাণী বা বস্তুতেও আপনি তাঁর নিপুণ সৃষ্টিশক্তির ছাপ খুঁজে পাবেন, যদি আপনি মন থেকে দেখতে ও বুঝতে চান।


 FAQ

Q.ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা কি সম্ভব?

A.ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা বিজ্ঞানের নিয়মে সহজ নয়, কিন্তু এটা ভাবা যায় তর্ক, দর্শন আর অভিজ্ঞতার মাধ্যমে। যেমন, দুনিয়ার নিখুঁত নিয়ম, প্রকৃতির সমতা, আর মানবদেহের জটিল গঠন—এসবই একজন বড় শক্তির অস্তিত্বের দিকে ইঙ্গিত করে। যেমন আমরা ঘড়ি দেখলে ঘড়ির গড়নের কথা ভাবি, তেমনি এই সুন্দর জগতটা একটি মহান স্রষ্টার অস্তিত্বের কথা বলে। তাই ঈশ্বরকে যুক্তি দিয়ে নয়, বরং বিশ্বাস, চেতনা আর অনুভবের মাধ্যমে বুঝতে হয়।

Q. বিজ্ঞান কি ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করতে পারে?

A. বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ বা অপ্রমাণ করতে পারে না, কারণ ঈশ্বর একটি অদেখা সত্তা এবং তিনি পরীক্ষাগারে দেখা যায় না। বিজ্ঞান মূলত পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষা ও যুক্তির মাধ্যমে কাজ করে, আর ঈশ্বরের ধারণা বেশি বিশ্বাস ও দর্শনের বিষয়। তবে বিজ্ঞান মহাবিশ্বের জটিলতা, নিয়ম ও জীবন সৃষ্টি নিয়ে অনেক প্রশ্ন তোলে, যা কিছু লোক ঈশ্বরের অস্তিত্বের সম্ভাবনা মনে করেন। অন্যদিকে, কিছু বিজ্ঞানী এই প্রশ্নগুলোকে প্রাকৃতিক নিয়ম দিয়েই সমাধান সম্ভব বলে মনে করেন। তাই, বিজ্ঞান ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে নিশ্চিত কিছু বলতে পারে না, তবে এ নিয়ে কাজ করা সম্ভব।


মন্তব্য: ঈশ্বরের অস্তিত্ব নিয়ে কথা বলতে গেলে, আমরা নিশ্চিত প্রমাণ হয়তো পাই না, কিন্তু অনেক কিছুই আমাদের ঈশ্বরে বিশ্বাস করতে প্রভাবিত করে। মহাবিশ্বের নকশা, জীবনের জটিলতা ও আমাদের নৈতিকতা অনেকের জন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বের একটা চিহ্ন। ধর্মগ্রন্থ ও ঋষি-মুনিদের অভিজ্ঞতা এই বিষয়টাকে আরও গভীর করে। যদিও ঈশ্বর দেখা যায় না, তবে হৃদয়ের অনুভূতি, বিশ্বাস আর আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার মাধ্যমে আমরা তাকে অনুভব করতে পারি। তাই বলা যায়, ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা প্রমাণ নয়, উপলব্ধি করা।

Post a Comment

0 Comments