ধর্মমতে জন্মদিন পালন

এই সু্ন্দর পৃথিবীতে অনেকেই আমরা আমাদের জীবনে নিজের ও আপনজনদের জন্মতিথি, জন্মদিবস বা জন্মদিন পালন করে থাকি।আধুনিক এই পৃথিবীতে তথা কলি যুগে পরিস্থিতি অনুযায়ী বিভিন্নভাবে ও ভিন্ন ভিন্ন উপায়ে পালন করে থাকি। যদিও কিছু সংখ্যক ধর্মানুরাগী মানুষ নিজের ইষ্ট কে ভোগ নিবেদন করে প্রসাদ গ্রহণ করেন আবার কেউবা পায়েস বা কেক কেটে নিজেদের জন্মদিন পালন করেন তাছারাও বর্তমানে আমরা অনেকেই নানা রকম রাজকীয় পদ্ধতি জন্মদিন পালন করে থাকি।কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সকল আনন্দ এবং উৎসবের কথা আমাদের মনে থাকলেও , হাজার আড়ম্বরপূর্ণ ব্যস্ততার মাঝে আমরা আমাদের সৃষ্টিকর্তা পালনকর্তা কে ভুলেই যাই।

ধর্মমতে জন্মদিন পালন

ধর্মমতে জন্মদিন পালনের ক্ষেত্রে ধর্মীয় গ্রন্থ সমূহের ব্যাখ্যা:

জন্মদিনে বৈদিক আচার অনুসারে পরমেশ্বরের কাছে যজ্ঞের মাধ্যমে প্রার্থনা করা আমাদের কর্তব্য। বিদ্যা, তেজ, বলবুদ্ধি ও পথপ্রদর্শন লাভের জন্য, দীর্ঘ ও সুখময় জীবন কামনায়, লাভ-ক্ষতির বিবেচনায় দুষ্কর্ম, দুর্গুণ ও দুর্ব্যবহার ত্যাগ করে সৎকর্ম, সদ্গুণ ও সদাচরণ গ্রহণের উদ্দেশ্যে যজ্ঞ করা উচিত। আজ আমি এমনই কিছু সহজ ও সংস্কারমূলক বৈদিক যজ্ঞমন্ত্র উল্লেখ করছি, যা জন্মদিনে বৈদিক বিধান অনুযায়ী আহুতি প্রদানের জন্য উপযুক্ত।

অউম-উপপ্রিয়ং পনিপ্নতং যুবানমাহুতীবৃধম্।

অগন্ম বিভ্রতো নমো^ দীর্ঘমায়ুঃ কৃণোতু মে।।

— (অথর্ববেদ ৭/৩১/১)

অর্থ: হে স্তুতিযোগ্য প্রিয় পরমেশ্বর, যেমন আহুতি দ্বারা আমি যজ্ঞাগ্নিকে প্রজ্বলিত করি, তেমনি সাত্ত্বিক অন্ন গ্রহণ করে আমি আমার আয়ু বৃদ্ধি করি এবং প্রতি বর্ষে জন্মদিন উদযাপন করতে থাকি।

অউম ইন্দ্র জীব সূর্য জীব দেবা জীবা

জীব্যাসমহম সর্বমায়ুর্জীব্যাসম্।।

— (অথর্ববেদ ১১/৭০/১)

অর্থ:- হে পরমেশ্বর, হে প্রভু দেব, আমাদের উত্তম জীবন দান করো। হে সূর্য দেব, হে দেবতাগণ, আমাকে দীর্ঘায়ু প্রদান করো।

অউম আয়ুষায়ুষ্কৃতাং জীবায়ুষ্মাঞ্জীব মা মৃথাঃ।

প্রাণেনাত্মন্ব জীব মা মৃত্যেরুদগা বশম্।।

অর্থ:-সংকল্প করছি—আমি মৃত্যুর অধীন নই; কর্মঠ, আত্মবিশ্বাসী ও ঈশ্বরভক্ত হয়ে মহাপুরুষদের পথ অনুসরণ করব। আয়ু লাভ করে জীবনভর শ্রেষ্ঠ কর্মের মাধ্যমে যশ অর্জন করাই আমার লক্ষ্য।।

অউম শতং জীব শরদো বর্ধমানঃ

শতং হেমন্তাঞ্ছতমু বসন্তান্।

শতমিন্দ্রাগ্নী সবিতা বৃহস্পতিঃ

শতায়ুষা হবিষেমং পুনর্দঃ।।

— (ঋগ্বেদ ১০/১৬১/৪)

অর্থ:-হে মানুষ, পুণ্যকর্ম ও সংযত জীবনযাপন করে শতবর্ষ বেঁচে থাকার চেষ্টা করো। বিদ্যুৎ, অগ্নি, সূর্য ও জ্ঞানের অধিপতি বৃহস্পতির কৃপায় মানব শতায়ু লাভ করতে পারে।

অউম সত্যামাশিষং কৃণুতা বয়োধৈ

কারিং চিদ্ধ্যবথস্বেভিরেবৈঃ।

পশ্চা মৃধো অপভবন্তু বিশ্বা

স্তদ্রোদসী শৃণুতং বিশ্ব মিন্বে।।

(অর্থব ২০/৯৯/১১)

অর্থ:-হে বিদ্বানগণ, আপনার ‘আয়ুষ্মান ভব’ আশীর্বাদ সফল হোক। আপনার প্রদত্ত জ্ঞানই অনুসারীদের রক্ষার মাধ্যম। আপনার পথনির্দেশে মানুষের সকল দোষ বিনষ্ট হয়। তাই হে জ্ঞানীজন, বেদোক্ত শিক্ষাদানে আমাকে কৃপা করুন।

১। অউম জীবাস্থ জীব্যাসং সর্বমায়ুজীর্ব্যাসম্।।

২। অউম উপজীবাস্থ সংজীব্যাসং সর্বমায়ুর্জীব্যাসম্।।

৩। অউম সংজীবাস্থ সংজীব্যাসং সর্বমায়ুর্জীব্যাসম্।।

৪। অউম জীবলাস্থ জীব্যাসং সর্বমায়ুজীর্ব্যাসম্।।

(অর্থব ১৯/৬৯/১-৪)

অর্থ:-জলের সমান শান্ত স্বভাব সজ্জনবৃন্দ।আপনারা আমাকে দীর্ঘায়ুর আশীর্বাদ প্রদান করুন।সদাচারণ ও প্রভু পূজা করে আমি আমার জীবন কে যেন বাড়াতে পারি।আপনারা আমাকে দীর্ঘ ও শ্রেষ্ঠ জীবনতত্ত্ব প্রদান করুন।আমি যেন আপনাদের সহায়তায় বা প্রেরণায় দীর্ঘজীবন প্রাপ্ত করতে পারি।

*অন্তিমে যত বছরের যজমান ততটি গায়ত্রী মন্ত্রের দ্বারা আহুতি প্রদান করে পূর্ণাহুতি এবং আশীর্বাদ মন্ত্রে দেবে ” হে (নামোচ্চারণ করে) ত্বং জীব শরদঃ শতং বর্দ্ধমানঃ আয়ুষ্মান্ তেজস্বী বচস্বী শ্রীমানভূয়াঃ।

Celebrating birthdays in religion
Celebrating birthdays in religion


ধর্মমতে জন্মদিন পালনের ক্ষেত্রে করণীয় ও বর্জনীয় কিছু বিষয়  নিম্নে আলোচনা করা হলো:

জন্মদিনে কি কি করা যাবেঃ

১।প্রথমেই সূর্যদেবতাকে প্রণাম করুন৷ জন্মদিনে সকালে উঠে । সূর্যের উদ্দেশ্যে অর্ঘ্য নিবেদন করে জন্মদিন শুরু করুন। এরপর আপনার ইষ্টদেবতাকে স্মরণ করে ধ্যান করুন। এর ফলে আপনার জন্মদিন শুরু হবে পজিটিভ এনার্জি পরিবৃত হয়ে।

২) জন্মদিনে নিজের আনন্দ তো নেবেনই, তবে সেই আনন্দ যেন শুধু নিজের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থাকে। এই দিনে গরিব-দুঃখীদের কথা ভুলে যাবেন না। দরিদ্রনারায়ণের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করুন—তাঁদের শস্যদানা ও প্রয়োজনীয় খাদ্য দান করুন। তাঁদের চরণ স্পর্শ করে আশীর্বাদ গ্রহণ করুন। দরিদ্রের মুখে ফুটে ওঠা একটুকরো হাসি আপনার জীবনের পথ চলার সার্থক পাথেয় হয়ে উঠবে।

৩) জ্যোতিষশাস্ত্র মতে, আপনার রাশি অনুযায়ী শুভ রঙের সুতো বা রত্ন ধারণ করুন। জন্মদিনে জ্যোতিষীর পরামর্শ অনুসারে ধাতব ব্রেসলেট পরাও শুভ হতে পারে – বিশেষ করে যদি এটি আপনার বড় ভাই বা বোন দ্বারা উপহার হিসেবে পাওয়া হয়। এটি আপনাকে নেতিবাচক শক্তি থেকে রক্ষা করতে সহায়ক হবে।

৪) জীবনে খারাপ সময় আসবেই ভালো সময়ের পাশাপাশি। তবে পজিটিভ এনার্জি সেই খারাপ সময়ের প্রভাবকে খর্ব করতে সাহায্য করে। নিজের চারপাশে পজিটিভ এনার্জি বাড়াতে জন্মদিনে রক্তদান করতে পারলে খুবই ভালো ফল পাওয়া যায়।

৫)আপনার জন্মছকে যে সব গ্রহ খারাপ অবস্থানে আছে যে শনি বৃহস্পতি ইত্যাদি  জন্মদিনে সেই সকল গ্রহের আরাধনা করুন। এর ফলে সেই সব গ্রহের অশুভ প্রভাব অনেকটা কমে যাবে।

৬)জন্মদিনে শিবলিঙ্গের রুদ্রাভিষেক করা অত্যন্ত জরুরি নিজ গৃহে। ২-৩ ঘণ্টা ধরে রুদ্রাভিষেক করলে আপনার মন পরিশুদ্ধ হবে এবং খারাপ সময় কেটে যাবে।

৭)জন্মদূরে মানুষের পাশাপাশি জীব সেবা বা পশুপাখিকে খাবার খাওয়ানো খুবই ভালো। আপনার সঞ্চিত অর্থ থেকে কিছু টাকা নিয়ে ঠাকুরের সামনে রেখে দিন। তারপর সেই টাকাটা কোনও গোশালায় দান করে দিতে পারেন। পশুপাখিকে খাবার খাওয়ালে তার শুভ ফল আপনার জীবনে প্রতিভাত হবে।

জন্মদিনের যেসব কাজ করা যাবে নাঃ

১)অহেতুক অন্য কারো মনে দুঃখ, কষ্ট বা ব্যথা দেওয়া যাবে না। 

২)মানুষ ছাড়াও সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টির এই প্রকৃতিকে কষ্ট দেওয়া যাবে।

৩)গুরুজনদের সাথে অভদ্রতা করা যাবে না।

৪) সদা সত্য কথা বলতে হবে অহেতুক মিথ্যা বলা যাবে না। 

৫)পরিবারের সাথে জন্মদিন করার চেষ্টা করতে হবে অযথা একা একা বাহিরে করা যাবে না।


জন্মদিন পালনের ইতিহাস 

জন্মদিনের কাহিনী বেশ পুরনো দিনের। মিশরের রাজা যখন "ঈশ্বর" হতেন, তখন তারা দিনটি পালন করত। গ্রিকরা দেবতাদের জন্য প্রথম জন্মদিন পালন শুরু করে। তারা চাঁদের দেবী আর্টেমিসের জন্য মোমবাতি দিয়ে কেক দিত, তখন থেকে কেক আর মোমবাতির চল শুরু। রোমানরা জন্মদিনকে নিজের মতো করে পালন করতছেলেদের জন্মদিন তেমন কিছু না, তবে মেয়েদের জন্মদিন অনেক পরে সবাই জানতে পারে। মাঝের সময়ে জন্মদিন পালন করা বারণ ছিল, কারণ খ্রিস্টানরা এটাকে অন্য সংস্কৃতি মনে করত। পরে খ্রিস্টানরা যিশুর জন্মদিন (বড়দিন) পালন করে এটাকে ধর্মের মধ্যে আনে। আঠারো শতকে জার্মানিতে "কিন্ডারফেস্ট" নামে বাচ্চাদের জন্মদিন পালন করার নিয়ম চালু হয়। তারা কেক বানাত, মোমবাতি জ্বালাত আর যা খুশি চাইত। ধীরে ধীরে এটা পুরো ইউরোপে ছড়িয়ে যায়। কলকারখানা হওয়ার পর কেক আর সাজানোর জিনিস পাওয়া সহজ হলে সাধারণ মানুষও এটা পালন করা শুরু করে। বিশ শতকে জন্মদিন পালনের নিয়ম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে যায়, যেখানে উপহার, কার্ড, পার্টি, গান যুক্ত হয়। "হ্যাপি বার্থডে টু ইউ" গানটি উনিশশো সালের দিকে লেখা হয়, আর এখন এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গাওয়া গানের মধ্যে একটি। এখন জন্মদিন শুধু বয়স বাড়ার দিন না, এটা নিজেকে চেনার আর ধন্যবাদ জানানোর দিন। এখনকার যুগে সামাজিক যোগাযোগ আর কম্পিউটারের কারণে জন্মদিন অন্যরকম হয়ে গেছে। এই দিনে মানুষ তার পরিবার, বন্ধু আর সমাজের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ভালো করে। এটা নিজেকে প্রশ্ন করার, ভালোবাসা দেওয়ার আর নতুন করে শুরু করার একটা চিহ্ন। তাই, জন্মদিন শুধু নিজের উৎসব না, এটা একটা সামাজিক আর সংস্কৃতির অংশ।

জীবনে আমরা অনেক সময় কুসংস্কারকে মুক্তির পথ ভেবে অনুসরণ করি, যার ফলে প্রতিবারই প্রতারিত হই। আসুন, আমরা বৈদিক সংস্কারের আলোকিত পথে জীবনকে গড়ে তুলি—যেখানে নেই কোনো বিভেদ, আছে পরম শান্তি ও আনন্দ। গর্বভরে বলুন: আমরা বৈদিক হিন্দু!


NB;জন্মদিনে এই কাজগুলি করলে সুখ, শান্তি ও সমৃদ্ধি অক্ষয় হয়ে জীবনে বিরাজ করবে।

#tag;

  • হিন্দুধর্মে জন্মদিন পালন
  • জন্মদিনে কি করতে নেই?
  • জন্মদিন পালনের ইতিহাস
  • জন্মদিন উদযাপন
  • জন্মদিন ও ইসলাম
  • জন্মদিন পালন করা যাবে কি
  • জন্মদিন কিভাবে পালন করতে হয়
  • জন্মদিন পালন করা যাবে কিনা
  • জন্মদিন পালন করা ঠিক কিনা
  • ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জন্মদিন উদযাপন: বৈধতা ও নিষেধাজ্ঞা"

Post a Comment

0 Comments