আমরা প্রায়ই বিভিন্ন দেবতাকে সৃষ্টিকর্তা বা ঈশ্বর হিসেবে ভেবে বসি। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, দেবতারা কখনোই সৃষ্টিকর্তা হতে পারেন না। কারণ এ প্রসঙ্গে ধর্মীয় গ্রন্থগুলোতে বিশদভাবে আলোচনা করা হয়েছে। এই কথা বলে আমরা দেব-দেবীর পূজা বা উপাসনাকে নিরুৎসাহিত করতে চাইছি না। বরং, আমরা এই বিষয়টি বুঝতে চেষ্টা করছি যে, দেব-দেবীর পূজা করা যায় মূলত ধন-সম্পদ লাভ, বিশেষ উদ্দেশ্য পূরণ, বা জীবনের কোনো নির্দিষ্ট সমস্যার সমাধানের জন্য। তবে, আমাদের মনে রাখতে হবে—যখন সেই লক্ষ্য পূরণ হয়, তখন দেব-দেবীর পূজার প্রতি অতিরিক্ত আসক্তি না রেখে ধীরে ধীরে আমাদের মনোযোগ প্রধান সৃষ্টিকর্তা বা পরমেশ্বরের উপাসনার দিকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
![]() |
হিন্দুদের প্রধান উপাস্য |
এখন আপনার মনে হতে পারে—দেব-দেবীর উপাসনা থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে, আমরা কাকে উপাসনা করব? এর সহজ উত্তর হলো—আমরা সেই পরম সৃষ্টিকর্তাকে উপাসনা করব, যিনি সমগ্র সৃষ্টির আদিস্বরূপ, সমস্ত মানুষের, ব্রহ্মাণ্ডের এবং এমনকি দেব-দেবীরও সৃষ্টিকর্তা।
এখানে আরেকটি সাধারণ প্রশ্ন জাগে—আদি বা প্রধান সৃষ্টিকর্তা কে?
অনেকের মতে, ব্রহ্মা আমাদের প্রধান সৃষ্টিকর্তা। কারও মতে শিব, আবার অনেকের মতে কালী বা দুর্গা। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এঁরা কেউই প্রধান সৃষ্টিকর্তা নন। কারণ, দেব-দেবীদেরও একটি নির্দিষ্ট জীবনকাল থাকে, এবং সময় শেষে তাঁদেরও মৃত্যু ঘটে।
হিন্দুদের প্রধান উপাস্য কে?
হিন্দু ধর্মের মূল ভাবনার ভিত্তিতে, প্রধান উপাস্য হচ্ছে একমাত্র সৃষ্টিকর্তা ভগবান। তিনি সমস্ত জীব ও জগতের স্রষ্টা। তবে, ভগবানের রূপ এবং নাম নিয়ে হিন্দু ধর্মে নানা মত রয়েছে। ধর্মগ্রন্থগুলির ব্যাখ্যা অনুযায়ী, এই সৃষ্টিকর্তাকে পরমেশ্বর বলা হয়, যার বিভিন্ন রূপ আছে যেমন নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ, শিব, এবং মা আদ্যাশক্তি (দুর্গা, কালী)। বেদ, উপনিষদ এবং গীতা অনুসারে, প্রধান সৃষ্টিকর্তা এবং উপাস্য হলেন পরম ব্রহ্ম বা পরমাত্মা, যিনি সকল কিছুর আদি কারণ। উদাহরণস্বরূপ, ব্রহ্মসুত্রে উল্লেখ করা হয়েছে:
"জন্মাদ্যাস্য ......"
অর্থাৎ, "যার থেকে সমস্ত সৃষ্টি উদ্ভব হয়েছে, তিনিই পরম ব্রহ্ম।"
ভগবদগীতা-তে শ্রীকৃষ্ণ নিজেকে এই পরম সত্তা হিসেবে প্রকাশ করেছেন:
"মত্তঃ পরম নান্যৎ কিঞ্চিদস্তি ধনঞ্জয়"
অর্থাৎ, "হে ধনঞ্জয় (অর্জুন), আমার ছাড়া আর কোনো পরম সত্তা নেই।"
অতএব, হিন্দু ধর্মে মূলত একজন নিরাকার ও শক্তিশালী সৃষ্টিকর্তাকে কে উপাস্য হিসেবে মানা হয়। তবে সময়ের সঙ্গে তিনি নানা রূপে হাজির হয়েছেন, যেমন শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীরাম, শিব, বা মা দুর্গা।
আরো বিস্তারিতভাবে জানতে আমাদের জানতে হবে হিন্দু ধর্মের প্রধান দেবদেবী সম্পর্কে তাই আমরা নিচে এ সম্পর্কে বিস্তর আলোচনা করছি..
হিন্দুধর্মে প্রধান দেবদেবী কারা?
হিন্দুধর্মে কিছু গুরুত্বপূর্ণ দেবদেবী রয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে অনেকেই পরিচিত এবং তাঁদের পূজা করা হয়। এই ধর্মটা অনেক বৈচিত্র্যময়, কিন্তু কয়েকটি দেবদেবী বেশ গুরুত্বপূর্ণ:
১. ব্রহ্মা: তিনি সৃষ্টিকর্তা, মানে সৃষ্টির কাজ করেন। কিন্তু ব্রহ্মার পূজা অন্যান্য দেবতাদের তুলনায় একটু কম হয়।
২. বিষ্ণু: তিনি ক্ষতি না হওয়ার জন্য এবং সৃষ্টির ঠিক চলা ঠিক রেখার দায়িত্বে আছেন। বিষ্ণুর অনেক অবতার আছে, যেমন শ্রীকৃষ্ণ, রাম, নারসিংহ। বিষ্ণুর পূজা হিন্দু ধর্মে খুব জনপ্রিয়।
৩. শিব: তিনি সৃষ্টির চক্রে ধ্বংস এবং পুনঃসৃষ্টি করেন। শিবলিঙ্গ পূজা অনেক গুরুত্বপূর্ণ। তাঁকে মহাদেব বা শঙ্কর বলেও ডাকা হয়।
বৈষ্ণবদের প্রধান উপাস্য: শ্রীবিষ্ণু ও কৃষ্ণ
শ্রী বিষ্ণু — যিনি ব্রহ্মাণ্ডের রক্ষাকর্তা এবং পালনকর্তা। বিষ্ণুর বিভিন্ন অবতার যেমন শ্রী রাম, নরসিংহ ইত্যাদির মাধ্যমেও উপাসনা করা হয়।
শ্রী কৃষ্ণ — বিষ্ণুর অষ্টম অবতার এবং বৈষ্ণব ধর্মের প্রধান ঈশ্বর। তিনি প্রেম ও ভক্তির প্রতীক, এবং তাঁর জীবন ও শিক্ষার উপর গীতার মতো মহাগ্রন্থ ভিত্তি করে বৈষ্ণব ধর্মের পথ চলা।
বৈষ্ণব ধর্মে কৃষ্ণ ভক্তি বা ভক্তির মাধ্যমেই মুক্তি ও ঈশ্বরের সাথে মিলন সাধনের উপর জোর দেওয়া হয়। তাই কৃষ্ণকে শুধুমাত্র দেবতা নয়, বরং পরম সত্তার সরাসরি অবতার ও জীবনের পথপ্রদর্শক হিসেবে মানা হয়।
![]() |
হিন্দুদের প্রধান উপাস্য দেবতা |
শৈবদের প্রধান উপাস্য: মহাদেব (শিব)
মহাদেব শিব — তিনি শৈব ধর্মের কেন্দ্রীয় দেবতা, যিনি ধ্বংসের দেবতা হিসেবে পরিচিত হলেও মূলত তিনি সৃষ্টির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও রক্ষারও প্রতীক। শিবের নানাবিধ রূপ যেমন নটরাজ, ভোলেনাথ, শঙ্খচূড়া ইত্যাদি তাঁর পূজার অংশ।
শৈব সম্প্রদায়ে শিবলিঙ্গ পূজা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। শিবকে পরমাত্মা, অনাদিম, অসীম ও সর্বশক্তিমান ঈশ্বর হিসেবে মানা হয়, যিনি সমস্ত জগৎ এবং দেবতাদের স্রষ্টা ও আধিপত্যশালী।
শৈব সাধকরা শিবের মাধ্যমে মোক্ষ লাভ, আত্মার মুক্তি ও আধ্যাত্মিক উন্নতির পথ অনুসরণ করেন।
শাক্তদের প্রধান উপাস্য: দেবী দুর্গা ও কালী
দেবী দুর্গা — তিনি রক্ষা ও শক্তির দেবী, যিনি অসুরদের বিনাশ করে জগতকে রক্ষা করেন। দুর্গা পূজা বিশেষ করে কার্তিক বা আশ্বিন মাসে অত্যন্ত উৎসবমুখর পরিবেশে পালিত হয়।
দেবী কালী — তিনি মহামায়া ও সময়ের দেবী, যিনি অন্ধকার ও অজ্ঞানতা দূর করে শুদ্ধি ঘটান। কালী পূজাও শাক্ত সম্প্রদায়ে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শাক্ত ধর্মে মহাদেবীকে আদ্যাশক্তি বা সর্বশক্তিময় মা হিসেবে পূজা করা হয়, যিনি ব্রহ্মাণ্ডের সমস্ত শক্তির উৎস। শাক্তাদের পূজার মাধ্যমে মা দুর্গা ও কালীর অবতরণ ও রূপায়ণ ঘটে, যাঁরা ভক্তদের জীবন ও সৃষ্টির সমস্ত দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তি দেন।
হিন্দুদের প্রধান উপাস্য বিষয়ে আরো গভীরভাবে আলোচনা করার জন্য আমাদের জানতে হবে একেশ্বরবাদ ও বহু দেবতার উপাসনা করার প্রসঙ্গে তাহলেই আমাদের প্রধান উপাস্য সম্পর্কে যে ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে তা থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারবো..
হিন্দু ধর্মে একেশ্বরবাদ vs বহু-দেবতা উপাসনা
হিন্দু ধর্মে একেশ্বরবাদ (Monotheism)
একেশ্বরবাদ মানে একটি সর্বোচ্চ, একক ঈশ্বরের অস্তিত্বকে মানা। এই ঈশ্বরকে বলা হয় পরমেশ্বর, পরমাত্মা, ব্রহ্ম বা ভগবান। একেশ্বরবাদে বিশ্বাসীরা এই এক ঈশ্বরকেই প্রধান উপাস্য ও স্রষ্টা হিসেবে মানেন। বিভিন্ন অবতার, দেবতা বা দেবীকে এই এক ঈশ্বরের বিভিন্ন রূপ বা প্রকাশ হিসেবে দেখা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, ভৈষ্ণব ধর্মে শ্রীকৃষ্ণ বা বিষ্ণুকে, শৈব ধর্মে শিবকে, শাক্ত ধর্মে দেবী দুর্গাকে প্রধান ঈশ্বর হিসেবে ধরা হয়, কিন্তু তাঁরা সবাই এক পরম সত্যের অবতার বা রূপ। বেদ, উপনিষদ, গীতা ইত্যাদির শাস্ত্রীয় বর্ণনায় একেশ্বরবাদ স্পষ্ট।
হিহিন্দুধর্মে বিভিন্ন দেবতা ও দেবীর পূজা অনেক আগে থেকেই প্রচলিত। প্রতিটি দেবতা বিশেষ কিছু শক্তি, গুণাবলী বা প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব করে থাকে। যেমন: ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা), বিষ্ণু (পালনকর্তা), শিব (সংহারকর্তা), লক্ষ্মী (ধন-সম্পদের দেবী), সরস্বতী (বিদ্যার দেবী), দুর্গা ও কালী (শক্তির দেবী) ইত্যাদি। বিভিন্ন সম্প্রদায় বা অঞ্চল অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন দেবতার আরাধনা দেখা যায়। বহু-দেবতা পূজা ধর্মের জীবন্ত অংশ এবং মানুষের দৈনন্দিন জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে মিশে আছে।
তাহলে এবার চলুন জেনে নিই—কোন দেবতার আয়ু কত?
পরমেশ্বর ভগবান শ্রীকৃষ্ণ — জন্ম ও মৃত্যুবিহীন, অনাদিকাল থেকে অনন্তকাল পর্যন্ত অমর।
ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব — প্রায় ৩১১.০৪ ট্রিলিয়ন বছর (১ ট্রিলিয়ন = ১,০০০,০০০,০০০,০০০)।
কালী, দূর্গা, ইন্দ্র, লক্ষ্মী, সরস্বতী — প্রায় ১৭ মিলিয়ন বছর (১৭,০০০,০০০)।
মানুষ — সাধারণত ১০০ বছর।
ভগবান যেসব দেবদেবীর মাধ্যমে পূজিত হন, তা সম্পর্কে শ্রীমদ্ভাগবত গীতা-তে বলা হয়েছে:
“তস্মিংস্তুষ্ট কিমপ্রাপ্যং জগতামীশ্বরেশ্বরে ।
লোকাঃ সপালা হ্যেতস্মৈ হরন্তি বলিমাদৃতাঃ ।।”
(ভাগবত ৪/১৪/২০)
এর অর্থ: পরমেশ্বর ভগবান বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডের বিভিন্ন দেবতার দ্বারা পূজিত হন। ভগবান যদি প্রসন্ন হন, তাহলে কিছুই অসম্ভব নয়। এজন্য বিভিন্ন গ্রহের দেবতা ও অধিবাসীরা ভগবানকে নানা প্রকার নৈবেদ্য নিবেদন করে মহা আনন্দ অনুভব করে।
এখন আমরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছি, আমাদের প্রধান উপাস্য কে?
সুতরাং, আসুন আমরা আর সময় নষ্ট না করে আজ থেকেই ভগবান শ্রীকৃষ্ণের আরাধনা শুরু করি এবং তাঁর নির্দেশিত পথ অনুসরণ করার চেষ্টা করি।
0 Comments