বিষ্ণু পুরাণ অনুযায়ী সৃষ্টির বর্ণনা অনুসারে, মহাবিশ্বের সৃষ্টির শুরু হয় বিশাল, অন্ধকারময় অবস্থায়, যেখানে কিছুই ছিল না। এরপর, বিষ্ণু স্বয়ং তাঁর অশেষ শক্তি দিয়ে এই সৃষ্টি প্রক্রিয়া শুরু করেন।
প্রথম অবস্থা: মহাবিশ্বের সৃষ্টির পূর্বে, শুধুমাত্র "নির্বাণ" বা "অবস্তা" ছিল, যা এক ধরনের বিশাল অন্ধকার এবং শূন্যতা ছিল। এটি "প্রলয়" বা মহাপ্রলয়ের সময় ছিল, যেখানে কোনও জড় বা চেতনাই ছিল না।
![]() |
বিষ্ণু পুরান অনুযায়ী মহাবিশ্ব সৃষ্টি |
বিষ্ণুর অবতার ও সৃষ্টির প্রক্রিয়া: বিষ্ণু তাঁর পবিত্র আশ্রয়ে "মহা বিষ্ণু" রূপে শয়নরত ছিলেন। তাঁর শরীরের একটি সুষম অগ্নি বা মহাসাগরের মধ্যে, তিনি নিজেকে উৎপন্ন করেন। এই অবস্থা থেকেই সৃষ্টির যাত্রা শুরু হয়। তিনি প্রথমে একটি পদার্থের সৃষ্টি করেন, যা পৃথিবীর সমস্ত সৃষ্টির আধার হয়ে ওঠে।
সৃষ্টির স্তর: প্রথমে ব্রহ্মা (সৃষ্টিকর্তা) কে সৃষ্টি করা হয়, যিনি সৃষ্টির কাজ শুরু করেন। তারপর, তিনি দেবতা, আশ্চর্য প্রাণী, মানুষ, বৃক্ষ, এবং অন্যান্য জীবের সৃষ্টি করেন।
ত্রৈলোক্য সৃষ্টির বর্ণনা: বিষ্ণু পুরাণে ত্রৈলোক্য (তিনটি পৃথিবী) সৃষ্টি করার কথা বলা হয়েছে— ভূলোক, স্বর্গলোক, এবং পাতাললোক। এই তিনটি দুনিয়া একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং পৃথিবী বা ভূলোক তাদের মধ্যে প্রধান।
এভাবে বিষ্ণু পুরাণে সৃষ্টির প্রক্রিয়া বর্ণিত হয়েছে, যেখানে বিষ্ণু স্বয়ং সবকিছুর পিছনে সৃষ্টির মূল শক্তি হিসাবে উপস্থিত।
হিন্দু ধর্ম অনুসারে মহাবিশ্ব কি করে সৃষ্টি হয়েছিল?
প্রথমে এই বিশাল ব্রহ্মান্ড ছিল শুধুই ফাঁকা, একদম শুন্যের মতন। সেই শুন্যস্থান তৈরি হল এক বিশাল আলোর ঝলক থেকে। সেই আলো একটু একটু করে মানুষের আকার নিতে শুরু করলো। সেই প্রথম মানুষটি হল ভগবান নারায়ন। তারপর নারায়ন গভীর ঘুমে ডুবে গেলেন। সেই ঘুম থেকে জল বের হয়ে ক্ষীর সাগরের জন্ম হলো। এরপর নারায়ণের পেট থেকে একটা পদ্মফুলের কুঁড়ি বের হলো আর নারায়ণের একজন সেই ফুল ফোটালো। ঐ পদ্ম থেকে ব্রক্ষার জন্ম হয়। এরপর নারায়ণের চোখের পলক থেকে একটা রুদ্রাক্ষের সৃষ্টি হয়। তারপর নারায়ণের একজন গিয়ে সেটার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে শিবের জন্ম দেয়। এরপর ব্রক্ষা আর শিব নারায়ণের প্রশংসা করে আর নিজেদের পরিচয় জানতে চায়, তারা বলে হে প্রভু আমাদের যখন জন্ম দিয়েছেন পরিচয়ও দিন। তখন নারায়ণ মৃদু হাসি দিয়ে বললেন, ‘আমি যেমন, তেমনি আপনারাও। আপনারা আমারই অংশ। হে পঞ্চমুখ, আপনি ব্রহ্মা—সৃষ্টি কর্তা। (একসময় ব্রহ্মার পাঁচটি মুখ ছিল; পরে শিব ত্রিশূল দিয়ে একটি মস্তক ছেদন করেন এবং তাঁর পূজা নিষিদ্ধ করেন।) আর আপনি, হে জটাধারী, হে ত্রিনেত্রধারী—আপনি মহাদেব, শিব। আমরা তিনজনই মিলে ত্রিদেব—সৃষ্টি, পালন ও সংহারের মহাশক্তির রূপ।
শ্রীনারায়ণের বাণী শুনে ব্রহ্মা ও মহেশ্বর তাঁদের জন্মের উদ্দেশ্য জানতে চাইলেন। তখন শ্রীনারায়ণ বললেন, ‘হে ব্রহ্মা, হে মহেশ, এই জগতে জন্ম নেওয়া মানেই কর্তব্য পালনের দায়িত্ব নেওয়া। তোমাদেরও কাজ করতে হবে। ব্রহ্মা, তুমি হবে সৃষ্টিকর্তা — জগতের সৃষ্টি তোমার হাতেই শুরু হবে। মহেশ, তুমি সংহারকারী — যখন সময় হবে, সবকিছুর সমাপ্তি তোমার দ্বারাই ঘটবে। আর আমি, নিরাকার থেকে সাকার হয়ে, নারায়ণরূপে এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের পালন করব। আমি হব পালনকর্তা, বিষ্ণুরূপে। এখন, ব্রহ্মা, তুমি গিয়ে সৃষ্টির কাজ শুরু করো।’** এই নির্দেশ পাওয়ার পর ব্রহ্মা ও শিব বিদায় নিলেন। তখন শ্রীবিষ্ণু শেষনাগের শয্যা থেকে উঠে দাঁড়ালেন এবং প্রণব মন্ত্র ‘ওম’ উচ্চারণ করলেন। শ্রীনারায়ণের বাম হাত থেকে আবির্ভূত হলেন মা মহালক্ষ্মী। তিনি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘হে পরমপুরুষ, তুমি তো পরিপূর্ণ, তাহলে আমায় কেন সৃষ্টি করলে?’ শ্রীবিষ্ণু মৃদু হাসি হেসে উত্তর দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমি জানি আমি সম্পূর্ণ। যেমন একটি প্রদীপ আরেকটি প্রদীপকে জ্বালালেও প্রথম প্রদীপের আলো নিভে যায় না, তেমনি আমার পূর্ণতায় তোমার আবির্ভাব কোনো ঘাটতি সৃষ্টি করে না। কিন্তু প্রিয়া, তোমাকে ছাড়া আমি অপরিচিত, অস্পষ্ট। যেমন চাঁদের আলো ছাড়া রাত নিঃসন্দেহে অন্ধকার, সুবাস ছাড়া ফুল যেন প্রাণহীন, তেমনি তুমি ছাড়া আমার প্রকাশ অসম্পূর্ণ। তাই আজ আমি ঘোষণা করছি—নারী ছাড়া কোনো পুরুষ পূর্ণ হতে পারে না। সেই পূর্ণতা থেকেই জন্ম নেবে নতুন সৃষ্টির সম্ভাবনা। আজ থেকে তুমি আমার নামের সঙ্গে যুক্ত হবে—তুমি হবে লক্ষ্মীনারায়ণ।’ মা লক্ষ্মী বিনয়ে নম্র হয়ে বললেন, ‘হে শ্রীহরি, তোমায় কোটি কোটি প্রণাম। এখন আমায় বলো, আমার কর্তব্য কী?’ শ্রীবিষ্ণু বললেন, ‘তুমি আমার প্রেরণা, প্রিয়া। তোমার অনুপ্রেরণায় আমি পালনকার্য সম্পাদন করব। আর ব্রহ্মা, তুমি সৃষ্ট জীবের কল্যাণে ধনের ধারায় আশীর্বাদ করবে।’ এরপর শ্রীনারায়ণ যোগনিদ্রায় প্রবিষ্ট হলেন এবং সেই যোগময় অবস্থান থেকে ব্রহ্মাকে শক্তি প্রদান করতে লাগলেন, যাতে তিনি নিজের সৃষ্টির কাজ সফলভাবে সম্পন্ন করতে পারেন।
![]() |
হিন্দু ধর্ম মতে মহাবিশ্বের ছবি |
ভগবান বিষ্ণু ও ব্রহ্মা যখন একসাথে সৃষ্টির কাজ শুরু করছিলেন, তখন সেটি কোনোভাবেই এগোচ্ছিল না। আসলে, এই বিলম্ব বিষ্ণুর এক মহালীলার অংশ ছিল। সময় কেটে যাচ্ছিল, কিন্তু সৃষ্টি এগোচ্ছিল না দেখে ব্রহ্মা উদ্বিগ্ন হয়ে বিষ্ণুর শরণাপন্ন হলেন। সে সময় বিষ্ণু গভীর যোগনিদ্রায় মগ্ন ছিলেন। ব্রহ্মা তাঁর কাছে গিয়ে ভক্তিভরে স্তব করতে লাগলেন। স্তব শুনে প্রসন্ন হয়ে বিষ্ণু চোখ মেললেন। ব্রহ্মা কাতরস্বরে বললেন, ‘হে ক্ষীরসাগরের অধিপতি, আমাকে রক্ষা করুন!’ ভগবান বিষ্ণু মিষ্টি হেসে বললেন, ‘শান্ত হও, আদি প্রজাপতি। উদ্বেগ এখন শোভা পায় না। ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই।’ ব্রহ্মা বললেন, ‘কিন্তু কিভাবে শান্ত থাকি, জগন্নাথ? আমি তো সৃষ্টি করবার জন্য জন্ম নিয়েছি, অথচ আমরা একত্রে এই কাজটি সম্পাদন করতে পারছি না। যদি এইভাবে চলতে থাকে, তবে আমার জন্ম ব্যর্থ হবে। প্রভু, আপনি আমাকে রক্ষা করুন।’ তখন নারায়ণ স্নিগ্ধ হাসিতে বললেন, ‘আপনি সৃষ্টিকর্তা, আমি পালনকারী। তবে আমাদের মধ্যে আর একজন আছেন যিনি এই মহাসৃষ্টির ভার গ্রহণ করবেন। তিনি হলেন মহাদেব। আপনি তাঁর কাছে যান, তিনি পথ দেখাবেন। তিনি—মহাদেব—আপনাকে সাহায্য করবেন, তখনই সৃষ্টির কার্য সফল হবে। কারণ সৃষ্টি মানে শুধু জন্ম নয়, তার সঙ্গে জড়িয়ে আছে পালন ও ধ্বংস। আর ধ্বংসের অধিপতি হলেন তিনি—সংহারকারী। তাঁর শক্তিই সৃষ্টির পরিপূর্ণতায় সহায় হবে। ভগবান বিষ্ণুর নির্দেশ অনুসারে ব্রহ্মা গেলেন শিবের শরণে এবং শ্রীহরির বার্তা ও অনুরোধ নিবেদন করলেন। তখন শিব গভীর যোগমগ্ন অবস্থায় নিজেকে বিভক্ত করলেন—শিব ও শিবা রূপে। এই দ্বৈত রূপেই প্রকাশ পেল আদি শক্তি। এরপর ত্রিদেব—ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও মহেশ্বর—তাঁদের সম্মিলিত শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করলেন নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ, জীব ও জড় পদার্থের বিস্ময়কর বিশ্ব। এদিকে, যখন বিষ্ণু যোগনিদ্রায় থেকে ব্রহ্মাকে শক্তি দিচ্ছিলেন, ঠিক তখনই তাঁর দুই কর্ণছিদ্র থেকে জন্ম নিল দুই অসুর—মধু ও কৈটভ। তারা ছিল অসীম শক্তির অধিকারী। সেই অসুরদ্বয় ব্রহ্মার উপর আক্রমণ চালাল। ভীত ব্রহ্মা আশ্রয় নিলেন বিষ্ণুর চরণে। তখন বিষ্ণু গদা দ্বারা অসুরদ্বয়ের বিনাশ ঘটালেন। গদার আঘাতে মধু-কৈটভের দেহ থেকে ছড়িয়ে পড়ল মেদ। বিষ্ণু তখন ব্রহ্মাকে আদেশ দিলেন, 'এই মেদ থেকেই গঠন করো পৃথিবী।' সেই অনুসারে ব্রহ্মা গঠন করলেন ধরণীকে। আর সেই কারণেই পৃথিবীর আরেক নাম হয়ে উঠল—মেদিনী।
সৃষ্টির পর, ব্রহ্মার চারটি হাত থেকে জন্ম নিল চার ঋষিপুত্র—সনক, সনাতন, সনন্দন ও সনৎকুমার। ব্রহ্মা তাঁদের উদ্দেশে নির্দেশ দিলেন—‘সৃষ্টি করো, বংশ বিস্তার করো।’ কিন্তু তারা ছিলেন ত্যাগ ও বৈরাগ্যের পথে নিবেদিত। সংসারজালে জড়াতে তারা কোনোভাবেই রাজি হলেন না। এই অমান্যতায় ব্রহ্মা প্রবল ক্রোধে ফেটে পড়লেন এবং তাঁদের ব্রহ্মলোক থেকে বহিষ্কার করলেন। এরপর ব্রহ্মা ভাবলেন, ‘সৃষ্টির আগে চাই শিক্ষা ও জ্ঞান—চাই যোগ্য শিক্ষক।’ এই ভাবনা থেকেই তিনি সৃষ্টি করলেন সপ্তর্ষিদের—জ্ঞান ও ধর্মের পথপ্রদর্শক হিসেবে। এরপর মানসপুত্র হিসেবে জন্ম দিলেন দুই মহাপুরুষের—দক্ষ ও নারদ। দক্ষকে দিলেন প্রজাপতির দায়িত্ব—জীবসৃষ্টির, আর নারদকে পাঠালেন ভগবত ভক্তির প্রচার করতে, লোককল্যাণের পথে। সবশেষে, ব্রহ্মা সৃষ্টি করলেন মনু ও শতরূপাকে—যাঁদের থেকেই সূচনা হয় মানবজাতির। তাঁরাই হলেন আমাদের প্রথম পিতামাতা।
এরপর ব্রহ্মার মনে হলো—তিনি এই মহাবিশ্বের স্রষ্টা, এই বিশাল সৃষ্টি তাঁরই কৃতিত্ব। এই ভাবনা থেকে তাঁর অন্তরে জন্ম নিল অহংকার। শিব বুঝতে পারলেন, এই অহংকার সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ের ভারসাম্যকে নষ্ট করতে পারে। তাই তিনি ব্রহ্মার কাছে গিয়ে তাঁকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন। কিন্তু অহংকারে অন্ধ ব্রহ্মা শিবের কথা শুনতেই রাজি হলেন না; বরং শিবকে অবমাননা করতে শুরু করলেন। তখন শিব ক্রুদ্ধ হয়ে মহারুদ্র রূপ ধারণ করলেন। সেই ভয়ংকর রূপে তিনি ত্রিশূল নিক্ষেপ করলেন ব্রহ্মার দিকে, যা তাঁর একটি মস্তক ছিন্ন করে দেয়। এই ঘটনার পর শিব ঘোষণা করলেন—ব্রহ্মাকে সব পূজা থেকে বহিষ্কার করা হবে। সেই মুহূর্তেই ব্রহ্মা উপলব্ধি করলেন তাঁর ভুল। তিনি অনুতপ্ত হয়ে শিবের স্তব করতে লাগলেন। শিব প্রসন্ন হয়ে বললেন, ‘হে আদি প্রজাপতি, তোমার পঞ্চম মস্তকই ছিল অহংকারের মূল। আমি সেটি নাশ করে তোমার অহংকার দূর করেছি। এখন তুমি প্রকৃত জ্ঞানে আলোকিত।’ এ কথা বলেই শিব অদৃশ্য হয়ে গেলেন। ব্রহ্মার পুত্রদের মধ্যে সাত ঋষি ও দেবর্ষি নারদ বুঝতে পারলেন—শিব এই কাজ করেছেন ব্রহ্মার কল্যাণের জন্য। কিন্তু ব্রহ্মার আরেক পুত্র, দক্ষ, এ সত্য অনুধাবন করতে পারলেন না। তিনি শিবকে শত্রু মনে করতে শুরু করলেন। বিশ্বে নানা ধর্ম থাকলেও, সনাতন ধর্মই এমনভাবে মহাবিশ্বের সৃষ্টি ও পরিচালনার যুক্তিসম্মত, বৈজ্ঞানিক ও গভীর দর্শন তুলে ধরে, যা আমাদের জন্য এক গর্বের বিষয়। একজন সনাতনী হিসেবে এ জ্ঞান ও ঐতিহ্যে আমরা গর্ববোধ করি।
মন্তব্য: হিন্দু ধর্মে মহাবিশ্বের সৃষ্টির ধারণা বেশ দারুণ। এখানে তিনজন দেবতা—ব্রহ্মা, বিষ্ণু এবং শিব—মিলে বিশ্বকে পরিচালনা করেন। ব্রহ্মা সৃষ্টি করেন, বিষ্ণু তার দেখভাল করেন আর শিব ধ্বংস করে নতুনের পথ খোলেন। দেবী শক্তিরও এই প্রক্রিয়ায় বড় ভূমিকা আছে, কারণ শক্তি ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়। হিন্দু ধর্মে বিশ্বকে আমাদের জীবনের একটা চক্র হিসেবে দেখা হয়, যেখানে সৃষ্টি, পালন আর ধ্বংস নিয়মিত ঘটে। এটা সনাতন চিন্তার মূল কথা। এই মহাবিশ্বকে কেবল পদার্থ হিসেবে না দেখে, বরং ঈশ্বরের লীলার অংশ হিসেবে ধরা হয়।
0 Comments